আবারও ভারী বর্ষণ শুরু হয়েছে। সেই বর্ষণের মাঝে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়েছে আমার মা। মা কি কাঁদছে? অঝোর বৃষ্টিতে তা বোঝা মুশকিল। তাকে খুব অসহায় আর বিপন্ন দেখাচ্ছে। মাকে এই মুহূর্তে হতবিহ্বল হরিণীর মতন মনে হচ্ছে; বাঘের তাড়া খেয়ে যে ক্লান্ত, পিপাসার্ত। সংসারের সীমাহীন সংকটে যে মহিলা বটবৃক্ষ হয়ে আগলে রেখেছিল আমাদের, আজ তাকে এমন বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত দেখে আমার বুকের কোথাও যেন হুহু কান্নার রোল পড়ে গেলো।
এই ঘনঘোর বর্ষার বর্ষণের মাঝে উঠোনে নেমে মায়ের হাত ধরে বললাম, ‘ঘরে চলো, মা।
হাত ধরতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আমার মা। আমি দেখলাম, মায়ের চোখ বেয়ে নেমে আসছে নোনা জলের স্রোত; এই স্রোত যেন শ্রাবণ-ধারার জলকেও হার মানিয়ে দেয়। যেন অনেক কষ্টে বাঁধ দিয়ে রাখা জোয়ারের জল, শেষ চেষ্টাটুকু করেও আর যাকে আটকানো গেলো না। আমি মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে রইলাম। এই স্নেহময় বুকে এক প্রলয়ংকরী ঝড় উঠেছে, যা কালবোশেখির ঝড়ের চাইতেও প্রবল। মহাসাগরের বুকে মহাদুর্যোগের সময় যে ঝড় ওঠে, সেই ঝড়ও মায়ের বুকের ঝড়ের কাছে নস্যি। সেদিন মা আমাকে মুখ ফুটে একটা কথাই বলেছিলো, ‘তোর বাপের মতো হোস নে, বাবা।
[দুই]
আজও বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। ঝড়ো হাওয়ায় লন্ডভন্ড প্রকৃতি। আমি দাঁড়িয়ে আছি অপারেশান থিয়েটারের করিডোরে। ভেতরে আমার স্ত্রী রেবেকা। প্রচণ্ড প্রসব বেদনায় সে কাতর। অপারেশন থিয়েটারের দরজার ফাঁক গলে আসা তার চিৎকার আমার বুকের ভেতরটাকে ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে। আজ আমাদের ঘরে নতুন আলো আসার দিন। ভয়, আশা আর আনন্দের ত্রিমুখী সংঘর্ষে আমি বিধ্বস্ত। বাইরের প্রকৃতির মতোই ছিন্নভিন্ন প্রায়। আমার মনে পড়ে যায় শৈশবের কথা। একদিন, এমন এক ঘনঘোর বরষা এবং আমার মা। আমি আর ভাবতে পারি না কিছুই। আমার মনে পড়ে যায় বড় আপার কথা, যে বছরখানেক আগে মরণ-জ্বরে মারা গেছে। সেদিন, সেই কালবোশেখি ঝড়ের দিনে আপা বলেছিলো, ‘চল, আমরা দুআ করি। সেদিনও অঝোর ধারার বৃষ্টি ছিলো। আচ্ছা, আপা কি জানতো বৃষ্টির সময় দুআ করলে সেই দুআ আল্লাহ কবুল করেন? হয়তো জানতো। সেদিন। কি আমি সত্যিই কোনো দুআ করেছিলাম? আমার মনে পড়ে না।
আমি আসমানের দিকে হাত তুলে বললাম, ‘পরওয়ারদিগার, আমার স্ত্রীকে ধৈর্য দিন। এই ভীষণ ব্যথা সইবার শক্তি তাকে দিন। আর, আমাকে কন্যাসন্তান দান করুন। আমি কন্যার বাবা হতে চাই।’
আজও বৃষ্টির কোনো থামাথামি নেই। আকাশে কালো মেঘের অবিরাম ছুটোছুটি। হঠাৎ মধুর এক কান্নার আওয়াজ! নতুন এক প্রাণের আবির্ভাবের সংকেত। আমার বুকের ভেতরে উথাল-পাথাল অবস্থা। কেমন আছে রেবেকা? আর, নতুন যে এলো সে?
একজন নার্স ছুটে বেরিয়ে এলো অপারেশন থিয়েটার থেকে। তার মুখ উজ্জ্বল। সে হাসিমুখেই বললো, আপনার মেয়ে হয়েছে।’
আমি তখন আনন্দে আত্মহারা! আল্লাহ আমার দুআ শুনেছেন? আমাকে কন্যার বাবা বানিয়েছেন? এতো দ্রুত আমার দুআ আসমান ভেদ করে আরশের মালিকের দরবারে পৌঁছে গেলো?
নার্স আরেক দৌড়ে বাবুটাকে নিয়ে এলো আমার কাছে। আমি ভালো করে দেখলাম তার চেহারা। দেখতে ঠিক যেন আমার মায়ের মতো। আমার মা, যে বুকের ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে আমার সামনে মারা গিয়েছিল। আমার কোল আলো করে যেন আমার মা-ই ফিরে এসেছে নতুন করে। সেই মা, যে কাকভেজা বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে, আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে বলেছিলো, ‘তোর বাপের মতো হোস নে, বাবা।’
আমি চুমু খেলাম আমার ছোট্ট মায়ের কপালে। সে চোখ মিটমিট করে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, ‘মা দেখো, আমি আমার বাবার মতন হইনি।
০৫. এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা
আগেরদিন বিকেলে একসাথে বসে চা খাওয়া বন্ধুটি যখন পরেরদিন না ফেরার দেশে চলে যায়, সেই শোক সামলানোর জন্য ঠিক কীরকম মানসিক প্রস্তুতি দরকার? মাঝে মাঝে মৃত্যুকে ভারি আশ্চর্য লাগে! বুকের বাম পাশে ধুকপুক। ধুকপুক করতে থাকা হৃৎপিণ্ডটা থেমে গেলে ভবলীলাটাই সাঙ্গ হয়ে যায়। মুহূর্তেই চেনাজানা একটা মানুষ হয়ে যায় অন্য জগতের বাসিন্দা।
বন্ধু জাহিদের মৃত্যুসংবাদ শোনার সাথে সাথে আমি যেন বরফের মতো জমে গেলাম। মনে হলো–আমার সমস্ত চিন্তাশক্তি স্থবির হয়ে গেছে। পাল্টে গেছে পৃথিবীর গতিপথ, থেমে গেছে পৃথিবীর চিরাচরিত ঘূর্ণন। ভীষণ বিপন্ন হয়ে ভেঙে পড়েছে মহাবিশ্বের সকল মহাকর্ষীয় শক্তি। প্রাণ-চল ধরণির কোথাও যেন আর এতোটুকুও প্রাণের স্পন্দন নেই।
‘জাহিদ বেঁচে নেই’–ব্যাপারটা যেন কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। মৃত্যুর এমন আকস্মিক আক্রমণে আমি বিপন্ন আর বিপর্যস্ত। মৃত্যু যে এতোখানি অনিশ্চিত এবং এতোখানি আকস্মিক–তা চিন্তা করতেও আমার নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে যেন।
চারপাশে নিত্যদিন কতো মানুষকেই তো মরতে দেখি। রোগে-শোকে প্রতিদিন কতো মানুষই তো মৃত্যুর মিছিলে ভিড় জমায়। কতো মৃত্যু-সংবাদ রোজ কানের পর্দায় এসে জানান দিয়ে যায় অস্থায়ী জীবনের অমোঘ বাস্তবতার। কিন্তু সেই মৃত্যুকে এতোটা কাছ থেকে দেখা হবে এতো শীঘ্রই–তা যেন কল্পনাতীত!
জাহিদের মৃত্যুটা আমাকে নাড়া দিয়ে গেলো ভীষণভাবে। আমি ব্যাধিগ্রস্ত জীর্ণ বৃদ্ধের মতো সমস্ত মনোবল সমেত ভেঙে পড়লাম যেন। এই শোক, এই বিরহ-ব্যথা সামলে উঠবার কোনো শক্তি আমি খুঁজে পেলাম না।