বড় আপার কথায় ভরসা আছে। তাকে কোনোদিন মিথ্যে বলতে দেখিনি আমরা। আজও যে মিথ্যে বলছে না সেটা জানি। কিন্তু, তাও মনে হচ্ছে আমি কিছু একটা জানতে পারছি না, অথবা আমাকে জানানো হচ্ছে না। কেন কে জানে! তবুও ফ্যালফ্যাল করে বড় আপার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মায়ের অনুপস্থিতিতে আপাই আমাদের সব। তার অনুগত থাকা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে আমাদের। আমার কৌতূহলী অথচ করুণ চেহারার দিকে তাকিয়ে আপার সম্ভবত মায়া হলো। মুখভরা একটা হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকালো বড় আপা। তার হাসিতে এতোক্ষণের গুমোট পরিবেশে মুহূর্তে প্রাণের হিল্লোল দোল খেলো যেন! আকাশ মেঘে ভর্তি, তবু মনে হচ্ছে চারদিক খুব হালকা। দুর্যোগের এই ঘনঘটার দিনেও বড় আপার মুখের এই হাসি অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেয়। চিন্তায় পড়ে যাওয়ার মতো কোনোকিছু মায়ের হয়নি। যদিও কিছু হয়ে থাকে, তা অবশ্যই ভালো কিছু। ভালো কিছুই যে হতে চলেছে, সেই সংবাদ একটু পরে আপার মুখ থেকেই শুনলাম অবশ্য। আমাদের ভাই-বোনদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে আপা একটা নির্মল, নিরুদ্বেগ হাসি দিয়ে বললো, ‘আমাদের ঘরে আরেকটা বাবু আসবে রে।’
আমাদের ঘরে নতুন বাবু আসার সংবাদে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছে রুমু। তার ধারণা, আসমান থেকে টুপ করে একেকদিন আমরা আমাদের ঘরের ভেনুতে এসে পড়েছি। বড় আপা, আমি, মারুফা এবং সে–আমরা সবাই। কিন্তু আজ যে ঘরের দরজাই বন্ধ। দরজা বন্ধ থাকলে আসমান থেকে বাবুটা কোথায় এসে পড়বে? চোখেমুখে বিস্ময় ধরে রেখে রুমু আবার পুতুল-খেলায় মন দিলো। একটু পরেই রুমুকে বরযাত্রী বিদেয় করতে হবে। তার হাতে এখনো কতো কাজ! মারুফাও চুপচাপ। বড় আপার কথায় তার মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেলো না।
বাইরে এখনো অঝোর ধারার বৃষ্টি। কিন্তু সেই বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে, একটা নতুন কান্নার আওয়াজ বাতাসের কাঁধে ভর করে ভেসে এলো আমাদের কানে। বুঝতে দেরি হলো না যে নবজাতকের কান্না! কান্নার সেই শব্দে আমি প্রায় আঁতকে উঠেছি বলা চলে। চোখভরা বিস্ময় নিয়ে কান্নার অকুস্থলের দিকে তাকিয়ে আছে রুমু। ঘরের দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও আসমান থেকে কোনদিকে বাবুটা ঘরে এসে পড়েছে। তা সে বুঝে উঠতে পারছে না। আজ সম্ভবত রুমুর বিস্মিত হবার দিন। মারুফাও ঘাবড়ে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কোনো সাড়া-শব্দ ছাড়াই সে চোখের পলক না ফেলে কান্নার আগমন-স্থলের দিকে তাকিয়ে আছে।
বয়স্ক মহিলাটা দরজা খুলে দাওয়ায় এসে দাঁড়াল। বড় আপাকে লক্ষ করে বললো, ‘মিনু, তোর বইন হইছে।’
আমাদের আরেকটা বোন হয়েছে। রুমু আর মারুফার আরও একজন খেলার সাথির আবির্ভাব ঘটেছে দুনিয়ায়। কিন্তু বড় আপার দিকে তাকাতেই তাকে বেশ বিমর্ষ দেখালো। তার বিপন্ন মুখাবয়বের কোথাও যেন কোনো অনিশ্চিত বিপদের সংকেত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, খুব অপ্রত্যাশিত কোনো ব্যাপার ঘটে গেছে, যার জন্য আমাদের কোনো প্রস্তুতি ছিলো না।
বৃষ্টির থামাথামির কোনো নামগন্ধ নেই। এরই মধ্যে কাজের পাওনা হিশেবে বয়স্ক ধাত্রী মহিলা কিছু চাল নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে মাথার ওপর অর্ধ ছেঁড়া একটা ছাতা ছাপিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আমাদের নতুন অতিথি এসেছে অনেকক্ষণ হয়ে গেলো। মা পাটিতে শুয়ে আছে। তার পাশে আগত নতুন মেহমান। রুমু পুতুল বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মারুফাও আরেকটু দূরে, বিছানো চাটাইতে হাত-পা গুটিয়ে বেশ আরাম করে ঘুমুচ্ছে। আমি আর বড় আপা বসে আছি মায়ের পাশে। বাইরের আকাশের মতো মায়ের চেহারাতেও একটা বিষণ্ণতার ছাপ। আমাদের অধীর অপেক্ষা বাবার জন্যে। প্রতিদিনের ন্যায় আজকেও দিনের বেলায় বাবা বাসায় নেই।
ভারী বর্ষণ একটু কমলো বটে, তবুও বাইরে গেলে গা ভিজে ছপছপ করবে। এরই মধ্যে, হুড়মুড় করে উঠোন ভেঙে বাবার আবির্ভাব হলো। বাবাকে খুব ভয় পাই আমরা। তার ভারি লাল লাল চোখ। পাথরের মতো শক্ত দু-খানা হাত। আমরা জানি, বাবার শক্ত হাতের কিল খেলেই আমাদের গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠে যায়। তাই বাবার কাছে কখনোই কোনো আদিখ্যেতা করার সাহস আমাদের কারও হয় না। বাবাকে সবচাইতে বেশি ভয় পায় মা। বাবার উপস্থিতিতে যেন মায়ের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। মায়ের এই ভয়ের কারণ আগে বুঝতাম না, কিন্তু আজকাল বুঝি। পান থেকে চুন খসলেই বাবার যে ভয়ংকর রূপ বেরিয়ে পড়ে, তাকে ভয় না করে উপায় কী? মায়ের পরে বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় বড় আপা। এরপর আমি। তারপর কে? সম্ভবত রুমু। মারুফা কি বাবাকে ভয় পায়? জানি না।
এরপরের ঘটনা খুব নাটুকে। নতুন কন্যাসন্তানের আগমন-বাণী শুনে বাবার সে কী তর্জন-গর্জন। বাবার এমন বীভৎস রূপ, এমন ভয়ংকর চেহারার কাছে বাইরের অশান্ত প্রকৃতিও যেন মামুলি! বাবার তাণ্ডবের কাছে কালবোশেখির মেঘের তাণ্ডবও যেন ফিকে হয়ে আসে।
এরপর কী থেকে যে কী হয়ে গেলো, কিছুই ভালোমতো বুঝে ওঠা গেলো না সেদিন। আমার মা, নিদারুণ প্রসববেদনা সহ্য করে যে খানিক আগেই জন্ম দিয়েছে একটি মানব-সন্তান, তাকে আমি আবিষ্কার করেছি উঠোনের মাঝে। জড়সড় অবস্থায়; কাঁদায় মাখামাখি। মা উঠে দাঁড়াতে পারছে না কোনোভাবে। উঠতে গেলেই ককিয়ে কেঁদে উঠে আবার মাটিতে ধপাস করে পড়ে যাচ্ছে। বড় আপা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ঘরের এক কোণে। ভয়ার্ত চোখমুখ নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে আমার দুটো বোন। রুমু আর মারুফা। নতুন যে এসেছিল, সেও চিৎকার জুড়েছে সমানতালে। ঘরে বাইরের এই সীমাহীন সংকটের সামনে আমি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।