ছমিরুদ্দিন আমাকে বলতে থাকে তার ভাগ্য বদলের গল্প, আর আমার স্মৃতি অতীত থেকে তুলে নিয়ে আসে জমিরুদ্দিন চাচার ওইদিনের বলা সেই কথাগুলো। চাচা একদিন নয়ন ব্যাপারীর চোখে চোখ রেখে, পরম ভরসার পারদ বুকে নিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহ কুরআনে কী কইছে হ্রনো নাই, মিয়া ভাই? আল্লাহ কইছেন, যারাই আল্লাহর ওপর ভরসা করবো, তাগো লাইগা আল্লাহ এমন জায়গা থেইকা রিজিক পাঠাইব যা মানুষ চিন্তাও করতে পারবো না। এইডাই আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহর ওয়াদা মিথ্যা হয়, কও? আমি আল্লাহর ওপরেই ভরসা করছি। আমার সন্তানগো জন্যে আমার টুপি বেচার ব্যবসাই সই। ওই ব্যবসাতেই আমার যা আয় হয় তা দিয়াই আমি চলমু। আমার পরে আমার ছেলেমেয়ে চলবো। বেচা-বিক্রি কম হলে কম খামু। সমস্যা নাই কোনো। কিন্তু আল্লাহর ঘর বানানির যে স্বপন দেখছি। মিয়া ভাই, এই স্বপন পুরা না কইরা মইরা গেলে বড় আপসোস থাইকা যাইবো’
ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি আর মনে পড়ছে নয়ন ব্যাপারীকে বলা জমির চাচার শেষ কথাগুলো, সত্যিই তো! যে রিজিক আসমান থেইকা আসে, তার লাগি এতো পেরশানি কিয়ের?
০৪. চাওয়া না-চাওয়া
[এক]
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে তখন। যদিও বৃষ্টির মৌসুম নয়; অবেলার বৃষ্টি। অবেলার বলেই হয়তো বা বড্ড বেপরোয়া প্রকৃতি। নিকষ-কালো মেঘে ছেয়ে আছে। মাথার ওপরের আকাশ। যেন ভীষণ অনিয়মে পৃথিবীতে নেমে এসেছে রাত্রি-প্রহর।
আমাদের ঘরে টিমটিমে একটি আলো জ্বলছে। বাতাসের ঝাঁপটায় নিভু নিভু অবস্থা; বাতাস একটু কমলেই সজোরে, ভীষণ বিস্ফোরণে সমস্ত শক্তিসমেত সেটা দপ করে জ্বলে ওঠে। বাতাস আর কুপি-বাতির মধ্যে যেন অলিখিত কোনো যুদ্ধ লেগেছে; কার শক্তি বেশি তা প্রমাণে উভয়পক্ষ বিলকুল মরিয়া।
আমাদের মাটির ঘর। বাতাসের আঘাতে আলোর ছিন্নভিন্ন অংশ জানালার ভেতর দিয়ে দাওয়ায় আছড়ে পড়েছে। সেই আলোতে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি আমরা চার জন। আমি, বড় আপা, রুমু আর মারুফা। আমাদের মধ্যে বড় আপার ছটফটানিটাই সবচেয়ে বেশি। সে একটু পরপর জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ঘরের ভেতর। তার চোখেমুখে আশা আর ভয়ের এক অদ্ভুত সমন্বয়। বড় আপা কেন যে ভয় পাচ্ছে জানি না। কী নিয়ে সে এতো আশা করে আছে তাও আমার ধারণার বাইরে। এই ঘন-ঘোর বৃষ্টি-বাদলের দিনে কেনই বা ঘরের ভেতরে আমাদের থাকার অনুমতি মিলছে না তাও বোধগম্য হচ্ছে না কোনোভাবে। রুমু পুতুল-খেলায় ব্যস্ত। আজ এই বান-বাদলের দিনে তার পুতুলের বিয়ে হচ্ছে; আদরের পুতুল-কন্যাকে কীভাবে সে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবে তা নিয়ে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। মারুফার সেদিকে কোনো মন নেই। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে; সম্ভবত কালো মেঘেদের ছুটোছুটিতে সে ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে।
মাকে দেখা যাচ্ছে না আজ; মনে হয় কোনো কাজে ভীষণ ব্যস্ত। কিন্তু এমন দুর্যোগের দিনে মা একটিবার আমাদের খোঁজ নেবে না, তা কী করে হয়? মায়ের কি তাহলে কোনো অসুখ করেছে? বড় কোনো অসুখ? যে অসুখ হলে বিছানা ছেড়ে ওঠা যায় না?
শব্দ করে কথা বলা যাবে না; বড় আপার নির্দেশ। একটু আগেই সে আমাদের কড়া শাসনের সুরে বলে রেখেছে, ‘খবরদার! কোনো শব্দ করিস নে যেন!
বড় আপার কড়া শাসনের শব্দে আমরা তিনজনই চুপ মেরে গেলাম। কিন্তু মাকে তো অনেকক্ষণ হয় কোথাও দেখছি না। নিদেনপক্ষে তার গলার আওয়াজ হলেও শোনার কথা। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে বড় আপার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম, মায়ের কি অসুখ করেছে আপা?’ সে আমার চাইতেও নিচু স্বরের ফিসফিসানি আওয়াজে বললো, ‘না।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে কী?’
‘মাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না যে?’
বড় আপা খানিকক্ষণ চুপ মেরে রইলো। যেন জটিল এক প্রশ্নের মুখোমুখি এনে ফেললাম তাকে। কিছুক্ষণ ভাবনা-চিন্তা করে আমার দিকে মুখ ফেরালো সে। আমার সতৃয় দৃষ্টিকে উপেক্ষা করা যাবে না দেখে বড় আপা বললো, ‘দেখবি। আরেকটু অপেক্ষা কর।
আরেকটু অপেক্ষা? ঠিক কতোক্ষণ অপেক্ষা করে থাকলে মিটে যাবে আরেকটু অপেক্ষার প্রহর? এই অনির্ধারিত, অমীমাংসিত, অনির্দিষ্ট ‘আরেকটু’ সময়কে পার করার জন্যে নতুন করে অপেক্ষার তপস্যা শুরু হলো মনে।
হঠাৎ খটখট আওয়াজ করে খুলে গেলো ঘরের সদর-দরজা। দরজা খুলে যেতেই ভেতর থেকে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে এলেন এক বয়স্ক মহিলা। চেহারায় তার প্রৌঢ়ত্বের ছাপ। এসেই বড় আপার কানে কানে ফিসফিসিয়ে কী যেন বললেন। বড় আপা এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করে কতোগুলো জিনিস জোগাড় করে মহিলার হাতে দিতেই সেগুলো নিয়ে তিনি আবার হনহন করে ঘরের ভেতরে ঢুকে ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিলেন। আমরা আরেকবার আলাদা হয়ে গেলাম। হয়তো বা আরও খানিকটা দীর্ঘায়িত হলো আমাদের অপেক্ষার প্রহর।
বড় আপা এবার নিজ থেকেই কথা বললো। ফিসফিসিয়ে নয়; বরং একটু জোরেই। বললল, ‘চল, আমরা হাত তুলে দুআ করি।’
আমি বললাম, ‘দুআ করবো কেন? মায়ের তো অসুখ করে নাই।’
বড় আপার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে; আমার এমন অকপট প্রশ্নের প্রশ্রয়ে বড় আপা সম্ভবত খুশি হতে পারেনি। চেহারা থেকে বিরক্তির রেশটুকু গলার মধ্যে টেনে নিয়ে, বেশ কর্কশ গলায় সে বললো, ‘বড় কথা শিখেছিস! অসুখ হলেই খালি মানুষ দুআ করে?’