মায়ের কাছে গল্প শুনি, আমাদের গ্রামও নাকি আর আগের মতো নেই। জায়গায় জায়গায় স্কুল হচ্ছে। হাসপাতাল হচ্ছে। রাস্তাঘাটগুলো পাকা হচ্ছে। শহরের সাথে তৈরি হচ্ছে সেতুবন্ধ। মা বলে, গ্রামের চেহারাটাই নাকি পাল্টে গেছে। কেমন পাল্টে গেছে কে জানে!
অনেকবছর পরে আমার বাড়ি যাওয়ার ছুটি মিললো। চোখেমুখে আমার সে কি আনন্দ! আমি ফিরে যাবো আমার মায়ের কাছে, আমার গ্রামের কাছে। যাক না। পাল্টে গ্রাম! উঠুক না বড় বড় দালান সেখানে! আমার গ্রাম তো। ওখানেই যে আমার নাড়ি পোঁতা। এক অদ্ভুত টান! নাড়ির টান।
গ্রামে ঢুকেই আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়লাম। এটাকে গ্রাম না বলে উপ-শহর বললেই ভালো মানাবে। আমাদের সেই অজপাড়াগাঁ, যেখানে দিনদুপুরে বিরাজ করতো মৃত্যুর মতন নিস্তব্ধতা, সেখানে এখন লোক আর লোকাঁচারের সে কি আওয়াজ, সে কি হই-হুঁল্লোড়! চারিদিকে মানুষের সে কি কর্মচাঞ্চল্য! একদিন যা ছিলো মরুভূমির মতো বিরান, তা এখন মুখরিত হয়ে আছে মানুষের পদাঘাতে। কাঁচা মাটির সোঁদা গন্ধ খুঁজে পাওয়া এখানে দুষ্কর হয়ে যাবে। আলোকায়নের এই আলো ঝলমলে যুগে আমাদের গ্রাম যেভাবে আগাচ্ছে, তাতে তার শহর হতে যে আর খুব বেশি দেরি নেই, তা সহজে অনুমেয়।
একদিন হঠাৎ জমিরুদ্দিন চাচার সেই মসজিদের কথা মনে পড়লো। আমার চোখের সামনে দিয়ে যে স্বপ্ন তরতর করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল একদিন, সেই স্বপ্নের সর্বশেষ অবস্থা জানতে ব্যাকুল হয়ে উঠলো মন। একজন সরল-সিধে বৃদ্ধ মানুষের চোখে যে স্বপ্নকে সেদিন আমি ঝকমক করতে দেখেছিলাম, গোটা বিদেশ-বিভুঁইয়ে, পৃথিবীর পথে-প্রান্তরে ঘুরেও সেই স্বপ্ন, সেই স্বাপ্নিক দুটো চোখ আর স্বপ্নের সেই উচ্ছ্বাস আর কোথাও খুঁজে পাইনি। ধরণির কোথাও দেখা মেলেনি আর একটা জমিরুদ্দিন চাচার।
আমি ছুটে গেলাম জমিরুদ্দিন চাচার মসজিদ দেখার জন্যে। চাচাঁদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ির মাঝে যে বিশাল বিস্তৃর্ণ বিল ছিলো একসময়, সেই বিল জুড়ে এখন মানুষের ঘর-বসতি। যে পানির সমুদ্র সাঁতরে একদিন যেতে ভয় পেয়েছিলাম জমির চাচার বাড়ি, সেই অথৈ পানির বিল এখন মানুষের পদচারণায় সরগরম। বিলের মাঝ দিয়ে একটা সুন্দর, সর্পিল রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে বিলের অপর প্রান্তে। এই বিস্তৃর্ণ জলাশয়, যাতে ছিলো কচুরিপানার অবাধ রাজত্ব আর হাঁসেদের জলকেলির অভয়ারণ্য, সেটা যে একদিন এমন নগর হয়ে উঠবে তা কে জানতো?
একটা সুউচ্চ, সুবিশাল গম্বুজের ঠিক শীর্ষদেশে গিয়ে আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। একটা আকাশভেদী মিনার যেন মহাশূন্যে পাড়ি জমাতে চাইছে প্রাণপণে। এটা কি নয়ন ব্যাপারীর সেই উঁচু ঢিপিটাই, যেখানে একদিন মাটি খুঁড়ার কাজ করেছি আমি, ছমিরুদ্দিন আর বয়োবৃদ্ধ জমির চাচা? স্বপ্নও কি এতোটা অবিশ্বাস্য, এতোটা বিস্ময়কর হতে পারে? নিজের চোখ দুটোকে যদি অবিশ্বাস করা যেতো আমি হয়তো তা-ই করতাম। কিন্তু যে সুদৃশ্য ইমারত আমার সামনে বর্তমান, যে আকাশছোঁয়া মিনার আমার দৃষ্টিজুড়ে, তা তো স্বপ্ন নয়, দিবালোকের মতো তা স্পষ্ট, আমার অস্তিত্বের মতোই তা সত্য।
এটাই সেই উঁচু ঢিপি এবং এটাই সেই মসজিদ। একদিন এখানেই নিজ হাতে জমিরুদ্দিন চাচা ছড়িয়ে গিয়েছিলেন স্বপ্নের বীজ। সেই স্বপ্ন-বীজ আজ মহিরুহ হয়ে আকাশ ছুঁয়েছে। এই মসজিদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে আরও অনেকগুলো দোকানপাট। কয়েকটা স্কুল। সাথে লাগোয়া একটা সুতার কারখানা। আমি যেন একটা অমীমাংসিত স্বপ্নের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমার খুব করে জানতে মন চাচ্ছে, কেমন আছে ছমিরুদ্দিন?
ছমিরুদ্দিন এখন বিশাল বড় ব্যবসায়ী। টুপি বুননের কাজটাকে সে এখন মস্ত বড় ব্যবসায় পরিণত করেছে। তার বোনের বিয়ে দিয়েছে ভালো গেরস্ত পরিবার দেখে। স্ত্রী-পুত্র আর কন্যা নিয়ে তারও এখন বনেদি সংসার।
আমাকে দেখে শুরুতেই চিনতে পারল না ছমিরুদ্দিন ভাই। আমি বললাম, আমারে চিনো নাই ভাই? আমি কাশেমের বাপের পোলা। হাত উঁচিয়ে বললাম, ‘ওই যে। দইনের মাঠ, ঐখানেই আমগো বাড়ি। একদিন তোমাগো মসজিদ দেখবার লাগি আইছিলাম। মনে পড়ে?
ছমিরুদ্দিন খুশিতে যেন লাফিয়ে উঠলো। বললো, ‘হয় হয়! আবু তাহের না তোর নাম? কেমন আছোস ভাই আমার? কখন আইছিলি?
ছমিরুদ্দিন ভাই আমাকে চিনলেন ঠিক ঠিক। আমার নামও মনে আছে তার। আমি বললাম, ‘আইছি গনা কয়দিন হইছে। কী অবস্থা ভাই কও তো? গাও গেরাম তো চিনবার পারি না। মসজিদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললাম, ‘এইডাই তো তোমাগো সেই মসজিদ, তাই না?
‘হ৷’
চোখেমুখে এক-পৃথিবী বিস্ময় ধরে রেখে জানতে চাইলাম, ‘কেমনে কী হইলো কও তো?’
হাতে থাকা হিশেবের খাতাটা বন্ধ করতে করতে ছমিরুদ্দিন বললো, ‘ম্যালা কাহিনি আবু তাহের। সব কমুনে। চল আগে চা খাই।‘
চা খেতে খেতে গল্প জুড়েছে ছমিরুদ্দিন ভাই। কীভাবে কী থেকে কী হয়ে গেলো তার সবিস্তার বর্ণনায় লেগে গেলো সে। এই মসজিদ, এই টুপির ব্যবসা এই পর্যায়ে আসার কাহিনি হিশেবে ছমিরুদ্দিন ভাই যা বললো তা এ রকম–’শহর থেকে কিছু মানুষ এসে এখানে একটা কারখানা করতে চাইলো। তারা পছন্দ করলো মসজিদের পাশের এই উঁচু জমিটাই। বর্ষাকালে পানি ওঠার ভয় ছিলো না বলেই তারা বেছে নেয় জায়গাটা। কারখানা হওয়ার বছরখানেকের মধ্যে এখানে আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে স্কুল আর মাদ্রাসা। কারখানায় যারা কাজ করতো, তারা পরিবার নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে এখানে চলে আসতে থাকে। গড়ে ওঠে জনবসতি। লোকজনে ভরে ওঠে নির্জন অল। তখন একটা মসজিদের খুব দরকার পড়ে যায় এলাকায়। সবাই মিলে ঠিক করলো জমির চাচার মসজিদটাকেই তারা মেরামত করে বড় করবে। ছমিরুদ্দিনের কাছে প্রস্তাব দিলে সে রাজি হয়ে যায়। সেই মসজিদ সংলগ্ন বাড়তি কিছু অংশে তারা ছমিরুদ্দিনের জন্য একটা দোকান বানিয়ে দিলো। সেই থেকে ছমিরুদ্দিন আর গ্রামে গ্রামে গিয়ে টুপি বেচে না। দোকানে বসেই ব্যবসা করে। আস্তে আস্তে তার টুপির সুনাম এবং প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে শহরে। শহরের বড় বড় ডিলারেরা তার কাছে এসে টুপির অর্ডার দিয়ে যায়। বেড়ে যায় ছমিরুদ্দিনের ব্যস্ততা। খুলে যায় রিজিকের দরজা। দিন যায় আর ছমিরুদ্দিনের ভাগ্য খুলতে থাকে। একটা দোকান থেকে ছমিরুদ্দিন এখন একটা আস্ত কারখানার মালিক।