এই যে–আপনার তো সবই আছে। একটা বড় কোম্পানির হর্তাকর্তা আপনি, কত লোক আপনার অধীনস্থ, বড় অঙ্কের টাকা মাস শেষে বেতন পান আপনি, কী বিশাল সাইজের গরু দিয়ে কুরবানি করেন, বছরের উমরাটাও হয়তো-বাদ যায় না। এতসব করেও অন্তরে কেন শান্তির লেশমাত্র পান না জানেন? কারণ আপনি প্রকৃতার্থে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্যুত। আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তাতেই আপনি ডুবে আছেন আগাগোড়া। আপনার সব থাকবে–উন্নতি, পদোন্নতি, বাড়ি আর গাড়ি। কিন্তু যা থাকবে না, তা হলো অন্তরের প্রশান্তি। এইটার জন্য বিস্বাদ হয়ে উঠবে আপনার জীবন। বিষিয়ে উঠবে আপনার দেহমন। এক অদৃশ্য যাতনার সাগরে ডুবে থাকবেন আপনি। আপনার দালানকোঠা হয়তো আকাশ ছোঁবে, আপনার ক্ষমতার বলয় হয়তো বহুগুণ বিস্তৃত হবে, আপনার নাম-যশ-খ্যাতি হয়তো সীমানা ছাড়িয়ে যাবে, কিন্তু অন্তরের অন্তর্দহনে পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হতে থাকবেন আপনি।
এটা কেবলই একটা উদাহরণ মাত্র। জীবনের পদে পদে, ব্যক্তিক কিংবা সামাজিক অথবা প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ হৃদয়ে অটুট রাখতে হবে। জীবনের প্রতিটা অলিতে-গলিতে আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে আল্লাহর হুকুম-আহকাম; তবেই আমরা প্রকৃত জীবনের স্বাদ লাভ করতে পারবো, নচেৎ আমাদের জীবন ভীষণ বিভীষিকাময় হয়ে উঠবে ধীরে ধীরে। আমরা হারিয়ে ফেলবো জীবনের ছন্দ। আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্যুত হলে আল্লাহ আমাদের জীবনকে কঠিন করে তুলবেন আর নিরানন্দ করে দেবেন জীবনের সবকিছু।
পাঁচ.
জীবনের গোলকধাঁধায় আমরা মাঝেমধ্যেই পথ হারাই। মাঝে মাঝে ভীষণ শূন্যতাবোধে যখন হাহাকার করে ওঠে মন, যখন জীবন খুঁজে পায় না জীবনের মানে, তখন জীবন থেকে এক টুকরো ছুটি নিয়ে আমরা নিজেকে খুঁজতে বসি। ভাবতে বসি–কোথায় গিয়ে ঠিক খেই হারাচ্ছে সব? হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়– ‘আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’। সেই আপনাকে, অর্থাৎ নিজেকে খুঁজে পেতে হলে, খুঁজে পেতে হলে জীবনের সত্যিকার মানে, আমাদের ফিরতে হবে আমাদের রবের দেখানো পথে। সেই পথে, যে পথ গিয়ে মিশেছে অনন্ত অসীমে।
———-
[1] সুরা আরাফ, আয়াত : ১৭২
[2] সুরা মারইয়াম, আয়াত : ৫৯
[3] সুরা আনকাবুত, আয়াত : ৪৫
[4]এতে সালাতের হক আদায় হয় না। কেবল সালাতের বিধান পালিত হয়।
[5] প্রাগুক্ত
[6] সুরা মারইয়াম, আয়াত : ৩২
[7] সহিহুল বুখারি : ১২০৬; সহিহ মুসলিম : ২৫৫০; মুস্তাখরাজু আবি আওয়ানা : ১১১২১; শুআবুল ঈমান :৭৪৯৪
[8] সুরা ত-হা, আয়াত : ১২৪
০২. যে সুতোয় বাঁধা জীবন
এক,
খুব কাছের এক ভাইয়ের সম্প্রতি ডিভোর্স হয়ে যায়। বেচারা জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছে সম্পর্কটা টেকানোর, কিন্তু কোনোভাবেই তা পারা গেল না। মেয়ের মায়ের একটাই কথা–তার সাথে নিজের মেয়েকে সংসার তিনি করতে দেবেন না। শেষমেশ মেয়ের মা’র জেদই জিতলো। তাদের সংসার নামক ফুলটা প্রস্ফুটিত হবার আগে কলিতেই ঝরে পড়লো। ভীষণ মন খারাপ নিয়ে ভাইটা যখন আমার কাছে এলো, কী বলে যে তাকে সান্ত্বনা দেবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভাঙা হৃদয় নিয়ে একপর্যায়ে ভাইটা আমাকে বললো, সে আর কোনোদিন বিয়ে করবে না। বিয়ের ওপর, আরো নির্দিষ্ট করে বললে মেয়েদের ওপর থেকে তার আস্থা উঠে গেছে!
গভীর দুঃখবোধ যে তাকে গ্রাস করেছে, তা আঁচ করতে পারলাম। তাকে বোঝালাম যে–এটা যতখানি না মেয়ে-ঘটিত ব্যাপার, তারচেয়েও বেশি তাকদির-সংশ্লিষ্ট। তাকদিরের ফয়সালা তো এমন-ই। তাকদিরের সকল ফয়সালা সর্বদাই যে আমাদের পছন্দনীয় হবে, অন্তত সাথে সাথে–তা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে আমাদের মনে হতে পারে, ‘হায়! আমার সাথেই কেন এমনটা হলো?’
মন খারাপের দিনে, যখন বিচ্ছেদ আর বিরহে কাতর হয়ে ওঠে মন, তখন সকল মর্মযাতনার মহৌষধ একটাই–তাকদিরকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া। এর অপর নাম তাওয়াক্কুল। আল্লাহর ওপর ভরসা করে যাওয়া।
আমার বন্ধু, যে বিরহ বেদনায় কাতর, তাকে তাকদিরের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। যদিও ব্যাপারগুলো আমার চাইতে তার বেশি ভালো জানা থাকার কথা, তথাপি। দুঃখের দিনে জানা বিষয়টাও কাছের মানুষের কাছে শুনতে মন্দ লাগে না। মন। ভাঙার দিনে কেউ যখন পাশে এসে একটু কোমল গলায় কথা বলে, যখন সান্ত্বনার সুরে মনে একটু সাহস যোগায়–মানুষের তখন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে হলেও বাঁচতে ইচ্ছে করে।
যদি আল্লাহ চান, এই সংসারের চাইতেও ভালো সংসার, এই জীবনসঙ্গীর চাইতেও ভালো জীবনসঙ্গী তাকে মিলিয়ে দেবেন। এই সংসারের কোথাও হয়তো তার জন্য অকল্যাণ লুকিয়ে ছিলো। কোথাও হয়তো-বা এমন অনিষ্ট লেপ্টে ছিলো, যা সে আজকের সময়ে বসে দেখতে পারছে না কিংবা বুঝতে পারছে না; কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে তা কোনোভাবেই অজানা আর অজ্ঞাত নয়। তিনি সময়ের স্রষ্টা আর তিনি জানেন, বান্দার জন্য ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে। যেহেতু তিনি তা জানেন, তাই অনুগ্রহ করে বান্দাকে বাঁচানোর জন্য তিনি যদি বান্দার জীবনের গল্পটাকে অন্যভাবে পাল্টে দেন, যদি আপাতদৃষ্টিতে ‘ঠিকঠাক বয়ে চলা জীবনের স্রোতকে তিনি অন্য খাতে, অন্যদিকে বইয়ে দেন, তাহলে হতাশ হয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। সম্মুখে থাকা সম্ভাব্য সকল ক্ষতি আর অকল্যাণ আল্লাহ-ই দেখতে পান শুধু, আমরা পাই না। তাই সেই অকল্যাণের হাত থেকে আমাদের উদ্ধারের নিমিত্তে যখনই তিনি আমাদের জীবনে বিচ্ছেদ ঘটাবেন, বিরহ যন্ত্রণায় আমাদের নিপতিত করবেন, যখন প্রিয় সাথির সাথে আমাদের সম্পর্কচ্ছেদ হবে, যখন প্রিয় মানুষ আমাদের জীবন থেকে চলে যাবে, তখন ভেঙে পড়া চলবে না। আমাদের জীবনের অপূর্ণ গল্পটাকে পুরা করবার ভার আল্লাহর ওপরই ন্যস্ত করতে হবে। আর আল্লাহ কখনোই তার অনুগত বান্দার জন্য অকল্যাণ চান না।