মায়ের সামান্য অবাধ্যতা জীবনে কীরকম বিপদ ডেকে আনতে পারে তার একটা দৃষ্টান্ত আমরা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে পাই। হাদিসে বনু ইসরাইল যুগের একজন নেককার বান্দার কথা বলতে গিয়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘বনু ইসরাইল সম্প্রদায়ে জুরাইজ নামে অত্যন্ত নেককার একজন লোক ছিলেন। আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য তার ছিলো আলাদা একটা জায়গা এবং সেখানে তিনি সারাদিন ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। একদিন এমনই এক সময়ে জুরাইজ যখন তার ইবাদতে মগ্ন, তার মা এসে তাকে ঘরের বাইরে থেকে ডাক দিলেন। মায়ের ডাক শুনে তিনি কি ইবাদত ত্যাগ করে মায়ের কাছে ছুটে যাবেন, না ইবাদত সম্পূর্ণ করে তারপর মায়ের ডাকে সাড়া দেবেন–এ নিয়ে ভারি দোটানায় পড়ে গেলেন। শেষপর্যন্ত ইবাদত সম্পূর্ণ করে তারপর মায়ের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি মনস্থির করলেন। এভাবে দ্বিতীয়বার এসে তার মা তাকে ডাকলেন, কিন্তু তখনো ইবাদতে রত থাকায় তিনি সাথে সাথে মায়ের ডাকে সাড়া দিতে পারলেন না। তৃতীয়বার আবারও তার মা এলেন এবং তাকে ডাক দিলেন। তৃতীয়বারও ছেলের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মা এবার হতাশ হয়ে বলে বসলেন, ইয়া আল্লাহ, কোনো এক নষ্টা নারীর মুখ দেখার আগে যেন ওর মৃত্যু না হয়।’
জুরাইজের ধর্মপ্রীতি এবং একনিষ্ঠ ইবাদত-বন্দেগির সুনাম তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো হুড়মুড় করে। সবাই তার দুনিয়া-বিমুখতা, খোদাভীতির প্রশংসায় গদগদ। সেসময় ওই এলাকায় এক পতিতার আগমন ঘটলো, পুরুষদের সাথে যে অবৈধ সম্পর্ক করে বেড়ায়। লোকের মুখে মুখে জুরাইজের গল্প শুনে সে বললো, ‘ও এই ব্যাপার! তোমরা দেখো, আমি যদি তার কাছে যাই, আমাকে দেখে সে তার ধর্মকর্ম শিকেয় তুলতে বাধ্য হবে।’
পতিতা বোঝালো–জুরাইজ যতই ধর্মকর্ম করুক, যতই আল্লাহওয়ালা হোক, তার রূপের কাছে জুরাইজকে হার মানতেই হবে। সকলে বললো, ‘তাই নাকি? তো যাও না, গিয়ে পারলে জুরাইজকে গিয়ে বলল এসব।’
সেই পতিতা জুরাইজের কাছে এলো এবং নানানভাবে সে জুরাইজকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলো; কিন্তু আল্লাহর বান্দা জুরাইজকে সে কোনোভাবেই প্রলুব্ধ করতে পারলো না। সে যারপরনাই ব্যর্থ হলো।
জুরাইজকে প্রলুব্ধ করতে না পারার বেদনা তার মাঝে প্রবল হয়ে উঠলো। অপমানের শোধ নিতে সে বেশ কদর্য এক কাজের দ্বারস্থ হলো। এক রাখালের সাথে সে শারীরিক সম্পর্কে জড়ায় এবং অনৈতিকভাবে এক সন্তান গর্ভে ধারণ করে। যখন সেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো, তাকে কোলে নিয়ে সে পুরো জনপদে ঘুরে ঘুরে বলে বেড়াতে লাগল, দেখে যাও তোমরা সবাই, জুরাইজ আমার সাথে ব্যভিচারে জড়িয়েছিলো। এই যে শিশুকে দেখছো, এটা জুরাইজের সন্তান।
বলা বাহুল্য–জনপদের সবাই হতবাক হয়ে গেলো এবং মহিলার এমন চাক্ষুষ প্রমাণ দেখে তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো যে–এহেন জঘন্য কাজটা জুরাইজই করেছে। জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে জুরাইজকে মারধর করতে শুরু করলো। শুধু তা-ই নয়, জুরাইজ যেখানটায় বসে এক ধ্যানে আল্লাহর ইবাদত করতো, সেই ঘরটাকেও তারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো।
জুরাইজের কাছে যখন শিশুটাকে আনা হলো, তখন তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমাকে তোমরা একটুখানি সময় দাও। আমি আমার রবের কাছে একটু প্রার্থনা করতে চাই।
জুরাইজকে সময় দেওয়া হলো। প্রার্থনা শেষে শিশুটাকে উদ্দেশ্য করে জুরাইজ বললেন, ‘বলো, কে তোমার বাবা?’
আল্লাহর কী অপার মহিমা, সদ্যজাত শিশুটা সকলের সামনে বলে উঠলো, ‘আমার বাবার নাম অমুক। আর অমুক জায়গায় সে মেষ চরায়।’
কোলের শিশুর মুখে এহেন জবাব শুনে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যায় সবাই! জুরাইজের ধার্মিকতা নিয়ে, তার আমল-ইবাদত নিয়ে যে সন্দেহ জেগেছিলো তাদের মনে, তা সাথে সাথে উবে যায়। তারা জুরাইজের কাছে বেশ অনুতপ্ত হয় এবং তার প্রার্থনার ঘরটাকে মাটির বদলে স্বর্ণ দিয়ে তৈরি করে দিতে চায়; কিন্তু সে প্রস্তাবে জুরাইজ সম্মত হলেন না। তিনি বললেন, ‘তার দরকার নেই। আমার ঘরটা আগে যেমন। ছিলো, তেমনটা করে দিলেই আমার জন্য যথেষ্ট।’[7]
হাদিসটা এখানেই শেষ হয়। এই যে আল্লাহর নেককার বান্দা জুরাইজের জীবনে এই বিপর্যয় নেমে এসেছিলো, এটা কেন হয়েছিলো? কারণ মায়ের ডাকে সাড়া না দেওয়ায় তার মা একদিন বিরক্তিভরে আল্লাহর কাছে এই বদ-দুআ করেছিলেন। তার মা আল্লাহকে বলেছিলেন, কোনো পতিতার মুখ না দেখিয়ে যেন আল্লাহ জুরাইজের মৃত্যু না দেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা জুরাইজের মায়ের সেই দুআ কবুল করেছিলেন। জুরাইজের মতো নেককার, আমলদার বান্দাকে তিনি ঠিকই পতিতার মুখোমুখি করেছেন এবং তাকে সম্মুখীন করেছেন ভয়াবহ লাঞ্ছনার। জুরাইজ কেবল প্রার্থনার মাঝে মগ্ন থাকতো বলেই তার মায়ের ডাকে সাড়া দিতে পারেননি এবং সেই কারণে এত কঠিন অবস্থার মুখোমুখি তার হতে হয়েছিলো। শাইখ আব্দুল মাজিদ প্রশ্ন করেছেন–আমরা যারা মোবাইল ইন্টারনেটে বুঁদ হয়ে থাকি সারাদিন, মায়েরা দশটা কথা বললে আমরা যারা একটা কথাও শুনি না, বিরক্তিভরে এড়িয়ে যাই, আমাদের মায়েরা যদি আমাদের জন্য কোনো বদ-দুআ করেন, তাহলে ভাবুন তো, জীবনে কী ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে আমাদের?