অন্যদিকে দ্বিতীয়জন দশটা বাজতেই ঘরের বাতি নিভিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। রাত আটটার দিকে সে ফেইসবুকে একটু ঢু মেরেছে বটে, তবে তা সাকুল্যে পনেরো মিনিটের জন্য। সাড়ে আটটার পর সে আর সোশ্যাল মিডিয়ায় আসেনি। দশটার দিকে বিছানায় এলে চোখে ঘুম নামতে তার সাড়ে দশটা বেজে যায় প্রতিদিন। এই আধ ঘণ্টার মাঝে সে রাতের যিকির-আযকারগুলো নিয়ম করে সেরে নেয়। এরপর সাড়ে দশটার দিকে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর তার অ্যালার্ম যখন বাজে, তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটে।
ফজরের ওয়াক্ত হয় সাড়ে চারটায়। এক ঘণ্টা সময় আগে জেগে সে চার রাকআত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করেছে, ছয় পৃষ্ঠা কুরআন তিলাওয়াত করেছে এবং শেষ রাতে করতে পেরেছে অধিক পরিমাণ ইস্তিগফার। মসজিদগুলোতে আযান হলে সে মসজিদে চলে গেলো। ফজর সালাত পড়ে সেখানে বসে পুনরায় কুরআন তিলাওয়াত করে, যিকির-আযকার সেরে, সালাতুল ইশরাক পড়ে নিয়ে ঘরে ফিরেছে সে। এতসবের পরেও তার হাতে যেন অফুরন্ত সময়! গা শীতল করা ঠান্ডা। পানি দিয়ে গোসল সেরে, কাপড়-চোপড় পরে সে রওনা করলো স্টেশনের দিকে। তার কাজগুলোতে কোনো তাড়াহুড়ো নেই কিন্তু।
খেয়াল করলে দেখবেন–দৃশ্যপটের প্রথম ব্যক্তি ঘুমিয়েছে পাক্কা পাঁচ ঘণ্টা। আর দ্বিতীয় ব্যক্তিও কিন্তু তার চেয়ে কম ঘুমায়নি। সে-ও পাঁচ ঘণ্টা ঘুমের চক্র পূরণ করে নিয়েছে, কিন্তু দৈনন্দিন রুটিনটাকে কেবল একটুখানি বদলে নিয়ে দ্বিতীয়জন যেখানে গভীর রাতে তাহাজ্জুদ, কুরআন তিলাওয়াত, আযকার, ফজরের সালাত, সালাতুল ইশরাক পড়েও খুব ধীরস্থিরভাবে অফিসে যেতে পেরেছে; একই পরিমাণ ঘুমিয়ে প্রথম ব্যক্তি তাহাজ্জুদ দূরে থাক, ফজরটা পর্যন্ত কাযা করে ফেলেছে। আর এই রুটিন মানতে গিয়ে অফিসে যেতেও তাকে রোজ হিমশিম খেতে হয়।
সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহারের এই এক উপকারিতা। এটা যেমন আপনার জীবনকে সহজ করবে, বাড়তি চিন্তা-টেনশান থেকে আপনাকে মুক্ত রাখবে, তেমনি জীবনের সবদিকে সময় ব্যয় করার জন্য অফুরন্ত রাস্তা দেখিয়ে দেবে। আপনার কখনোই মনে হবে না যে, আপনি একজন ব্যর্থ মানুষ কিংবা আপনার জীবনটা বড্ড জটিল। অন্যদিকে যদি সময়ের সঠিক ব্যবহার আপনি নিশ্চিত না করতে পারেন, সময়ের অবাধ অপচয়ে আপনি যদি অভ্যস্ত হয়ে পড়েন, আপনার জীবন ধীরে ধীরে জটিল থেকে জটিলতর হতে শুরু করবে। নিজেকে তখন আপনার কাছে ভীষণ ব্যর্থ মানুষ বলে মনে হবে। মনে হবে, একজীবনে যা কিছু করার ছিলো, তার কিছুই যেন আপনার করা হচ্ছে না। মানসিকভাবে আপনি খুব বিপর্যস্ত থাকবেন।
তিন.
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ তার কিতাবুর রুহ গ্রন্থে একটা ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, একজন পিতা একদিন তার মৃত মেয়েকে স্বপ্নে দেখলেন। স্বপ্নে তিনি মেয়ের কাছে জানতে চাইলেন, ‘মা, আমাকে আখিরাতের ব্যাপারে কিছু বলো।
তার মেয়ে বললো, ‘বাবা, আমাদের সামনে খুবই গুরুতর বিষয় এসে হাজির হয়েছে। আমরা দুনিয়ায় সবকিছু জানতাম ঠিক, কিন্তু মানতাম না কিছুই। আল্লাহর কসম করে বলছি বাবা, এখানে এসে যেসব বিষয়ের মুখোমুখি আমরা হচ্ছি, তা এড়াতে আমার আমলনামায় কেবল একটা তাসবিহ অথবা দুই রাকআত সালাত যদি যোগ করা যেতো, গোটা পৃথিবী লাভের চাইতেও তা আমার কাছে অধিক প্রিয় আর দরকারি হতো।[১]
‘আমরা জানতাম কিন্তু মানতাম না!’ খেয়াল করে দেখুন তো আমরা কী কী জানি। আমরা জানি, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আমাদের জন্য ফরয। ফরয হালকা কোনো শব্দ নয়। মন চাইলে পাশের টঙ দোকানে গিয়ে এককাপ চা খাওয়া কিংবা ইচ্ছে করলে রমনা পার্কে ঘুরে বেড়ানোর মতো ব্যাপার নয় এটা। ফরয শব্দের ভারত্ব এতবেশি, যে ব্যক্তি তা অনুধাবন করতে পারে, কেবল সেই তার মর্ম বোঝে। অক্সিজেন গ্রহণ করা ছাড়া আপনাকে যদি পাঁচ মিনিট বাঁচতে বলা হয়, আপনার দ্বারা কি তা আদৌ সম্ভব? আপনি বলবেন–তা আবার হয় নাকি! সত্যিই হয় না।
ঠিক একইভাবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত বাদ দিয়ে একজন মুসলিমের দিন কল্পনা করা যায় না। সালাত তার কাছে অক্সিজেন গ্রহণের মতোই জরুরি। অক্সিজেন তার দৈহিক সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখে, আর সালাত বাঁচিয়ে রাখে তার আত্মিক সত্তাকে। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত যে আমাদের জন্য ফরয করা হয়েছে এবং তা আদায় করা যে অত্যাবশ্যকীয়। এক দায়িত্ব, তা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। কিন্তু তবু ঠুনকো কারণে অথবা কারণ। ব্যতিরেকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমরা মসজিদে যাই না, জায়নামায বিছিয়ে বসি না। আমরা জানি মুসলিমদের জন্যই সালাত, কিন্তু আমরা তা মানছি কই? দুনিয়ার সমস্তকিছুর জন্যে আমরা সময় করতে পারি, সময় বের করতে পারি, কিন্তু সালাত আদায়ের জন্য সময় করা আমাদের হয়ে ওঠে না।
‘আমরা জানি সবই, কিন্তু মানি না কিছুই’–এটা যেন আমাদের জীবনের পরতে পরতে লেপটে থাকা এক অমোঘ সত্য বাণী। আমরা জানি, আমাদের জীবন ঠিক স্রোতে প্রবাহিত হচ্ছে না, কিন্তু সঠিক স্রোতে ফিরে আসার তাড়নাও আমাদের মাঝে নেই। আমরা জানি, আমাদের ইনকাম হালাল পথে আসে না, আমরা
অফিসের কাজে ফাঁকি দিয়ে অন্যের হক নষ্ট করি; আমরা জানি, ঘুষ ও সুদ দুটোই হারাম–তথাপি এসবের সাথে আমাদের নিত্য ওঠাবসা। পরনিন্দা করা, অন্যের ক্ষতি করা, অন্যকে খাটো করা, অপমান করা, মিথ্যা বলা, হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, অশ্লীল জিনিস দেখা, গান-বাজনায় মত্ত থাকা–এসবকিছুই আমাদেরকে আল্লাহর রাস্তা থেকে ছিটকে দেয় জেনেও আমাদের সংবিৎ ফেরে না। আমরা জানি, কিন্তু মানি না। এই না মানার যে কোনো খেসারত হবে না, এটা যেদিন বুঝবো আমরা, সেদিন সত্যিকার অর্থেই অনেক দেরি হয়ে যাবে। স্বপ্নে সেই মৃত মেয়েটা যেরকমভাবে তার পিতাকে বললো, একটা তাসবিহ, অর্থাৎ–একবার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলে তা আমলনামায় যোগ করাটা আজ আমার কাছে গোটা দুনিয়া লাভের চাইতেও বেশি মূল্যবান’, আমাদেরকেও একদিন এভাবে আফসোস করতে হবে। আমাদের মনে হবে–’ইশ! রাতের পর রাত যে সময়গুলো আমি ফেইসবুক স্ক্রল করে কাটিয়েছি, তার কিছুটা সময় যদি শেষ রাতে উঠে জায়নামাযে পার করতাম, তাহলে আজ আমাকে এই দুর্দশায় পড়তে হতো না। ইউটিউবে ঘন্টার পর ঘণ্টা মুভি দেখেছি, নাটক দেখেছি, কমেডি শো উপভোগ করেছি, হায়, তার কিছু সময় যদি আমি আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করে কাটাতাম! যে রমণীর উত্তরের আশায় ব্যাকুল নয়নে আমি ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেছি, সেরকম ব্যাকুলতা নিয়ে যদি আল্লাহর যিকির-আযকারে মশগুল থাকতে পারতাম! আমাদের এমন আফসোস যে নিশ্চিতভাবেই হবে, তা কুরআন কর্তৃক স্বীকৃত। সুরা আল-ফাজরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন–