তিন.
যদি জান্নাতে যেতে পারি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে একটা সমুদ্র চাবো। আমার সেই সমুদ্রের পাড়ে একদিন দাওয়াত করবো নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। সমুদ্রের অঢেল ফেনারাশির দিকে তাকিয়ে আমি নবিজিকে বলবো-ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি সমুদ্র ভালোবাসতাম। একদিন পাড়ে এসে সমুদ্রের ফেনারাশির বিস্তৃতি দেখে আমি যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে যাই। তারপর অন্য আরেকদিন আপনার একটা হাদিসে সমুদ্রের ফেনারাশির উল্লেখ পেয়ে আমি হারিয়ে যাই আমার পূর্বের সেই স্মৃতিতে। ওই হাদিসটা আমার মনে এত গভীরভাবে দাগ কেটে যায় যে– আপনার শেখানো আমলটাকে আমি আমার জীবনের পাথেয় করে নিই।
আমি কোন হাদিসটার কথা বলছি তা কি নবিজির মনে পড়বে? যদি মনে পড়ে তবু আলাপটাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য তিনি হয়তো জিগ্যেশ করবেন, কোন হাদিসটার কথা বলছো, বলো তো।’
‘ওই যে, সালাতের পরে তাসবিহ [২], তাহমিদ [৩] আর তাকবিরের[৪] পরে যে দুআটা পাঠ করলে আল্লাহ বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন বলেছিলেন আপনি, সেটা।
এমনকি বান্দার গুনাহ যদি সমুদ্রের ফেনারাশির পরিমাণও হয়, তবু। জানেন ইয়া রাসুলাল্লাহ, একজীবনে এত এত গুনাহ করেছি যে, মাঝে মাঝে মনে হতো আমার গুনাহের স্তূপ করলে তা উচ্চতায় আকাশ স্পর্শ করবে; কিন্তু আমার পরম করুণাময় রব আমাকে মাফ করে দিয়েছেন। এমনকি আমার একটা সমুদ্র নিজের করে পাওয়ার শখ ছিলো বলে তিনি আমাকে এই সুবিশাল সমুদ্রটা উপহারও দিয়েছেন। কী সুমহান, কী অপার দয়া আমার রবের! আলহামদুলিল্লাহ!
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হয়তো মুচকি হেসে বলবেন, ‘রব্বানা ওয়া-লাকাল হামদ! সমস্ত প্রশংসা কেবল আমার রবের! দেখলে আরিফ, আমার রবের কোনো ওয়াদা মিথ্যে ছিলো না।
সত্যিই, আমাদের রবের কোনো ওয়াদাই মিথ্যে নয়।
———–
[1] সহিহ মুসলিম : ৫৯৭; সুনানুন নাসায়ি : ৯৭৯৭; মুআত্তা মালিক : ২২; সহিহু ইবনি হিব্বান : ২০১৩; সহিহু ইবনি খুযাইমা : ৭৫০
[2] তথা সুবহানাল্লাহ।
[3] অর্থাৎ আলহামদুলিল্লাহ
[4] তথা আল্লাহু আকবার
১৬. এবার ভিন্ন কিছু হোক
এক.
একটা চিরাচরিত বৃত্তে কেমন উদাসভাবে কেটে যাচ্ছে আমাদের দিনগুলো। একটা গতানুগতিক সকাল, একটা হাঁপিয়ে ওঠা দুপুর, বিষণ্ণ বিকেল, মিইয়ে আসা সন্ধ্যে আর দিনশেষে দীর্ঘশ্বাসের একটা রাত–যেন যাচ্ছেতাই একটা জীবন!
মাঝে মাঝে আমি ‘সময়’ নিয়ে চিন্তা করি। কী দুর্দান্ত এক সম্পদ এই জিনিসটা! প্রতিদিন নিয়ম করে চব্বিশটা ঘণ্টার ঝুড়ি হাতে নিয়ে সে আমাদের দুয়ারে চুপচাপ এসে দাঁড়ায়, কিন্তু কিছুই বলে না। যেন তার কথা বলতে মানা অথবা আমাদের ব্যাপারে সে খুব বেখেয়াল। সে শুধু ঝুড়িটা আমাদের সামনে তুলে ধরে আর বলে– ‘এই নাও, তোমার আজকের দিনের চব্বিশ ঘণ্টা।’
আমাদের সামনে দৈনিক ঘণ্টার ঝুড়ি ঝুলিয়ে দিয়ে সে একেবারে চুপ মেরে যায়। আর কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বেরোয় না।
আমি ভাবি–দৈনিক এই চব্বিশ ঘণ্টা হাতে পেয়ে একজন মানুষ আসলে কী কী করে?
একজন মানুষ তার দৈনিক চব্বিশ ঘন্টা থেকে আট ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। বাকি যোনো ঘণ্টার মধ্যে বেশ লম্বা একটা সময় তাকে পার করতে হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। এর বাইরে সিনেমা-নাটক দেখা, গান শোনাসহ অন্য অনেক কাজে তার আরো বেশকিছু সময় ব্যয় হয়। এসবকিছুর পরে যেটুকু সময় মজুত থাকে, সেটুকু নিজের কাজে, পড়াশোনায়, পরিবারে দিতে গিয়ে তাকে রোজ রোজ হতে হয় গলদঘর্ম।
তাকে যখন জিগ্যেশ করা হয়, ‘কেমন যাচ্ছে দিন?’ সে বলে, ‘এই তো, চলছে…।’
কিন্তু এটাকে কি সত্যিই ‘চলা’ বলে?
মানবজীবন বড় রহস্যময়! মানুষ জানে না, দুনিয়ায় তার ঠিক কত দিন থাকা হবে। সে শুধু জানে, তাকে একদিন ঠিক ঠিক এই রঙিন দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। সে আরো জানে–এই একটা জীবনই দুনিয়ায় তার শেষ জীবন। সে আর চাইলেও কোনোদিন দুনিয়ার আলো-হাওয়া-জলে ফিরতে পারবে না। হাজার ইচ্ছে হলেও মৃত্যুর পর দুনিয়ায় এসে সে তার আপনজনের সাথে কাটাতে পারবে না একটা মুহূর্ত। যে সকালটা সে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতো রোজ, সেই সকালটাকে কর্মমুখর করে কাটানোর একটা সুযোগ সে আর কোনোদিন পাবে না। যে দুপুর অলসতায় কেটে যেতো তার, সেই দুপুরকে চাঞ্চল্যতায় ভরে তোলার অভিপ্রায় তার আর পূরণ হবে না। সে কাটাতে পারবে না একটা যথার্থ বিকেল, একটা মনে রাখার মতো সন্ধ্যে কিংবা ভুলতে না পারার মতো একটা রাত। কারণ– মৃত্যুর পরে তার সাথে দুনিয়ার সকল হিশেব-নিকেশ চুকে যাবে।
তবে কর্মমুখর সকাল, চল দুপুর, যথার্থ বিকেল, মনে রাখার মতো সন্ধ্যে আর ভুলতে না পারার মতো রাত–এসবকিছু উপভোগ সে করতে পারতো, যদি না একটা আস্ত মানবজীবন সে অনায়াসে অপচয় করতো।
দুই.
দুটো দৃশ্যপট আমি আপনার সামনে সাজাতে পারি। দুই জায়গাতে আপনার দুই অবস্থা সহজেই আপনি ধরতে পারবেন।
ধরা যাক, একই অফিসের দুইজন লোকের ডিউটি আগামীকাল সকাল আটটায় শুরু এবং যেভাবেই হোক সকাল সাড়ে সাতটার ট্রেন তাদেরকে অবশ্যই ধরতে হবে।
এই দুই লোকের একজন জেগে আছে রাত দুটো পর্যন্ত। দুটো পর্যন্ত জেগে সে কী করেছে? মাইলের পর মাইল ফেইসবুক স্ক্রল করেছে, ইউটিউব ব্রাউজ করে কোনো বক্স অফিস হিট করা মুভি কিংবা বেশ তাক লাগানো কোনো নাটক দেখেছে। রাত দুটোর দিকে ঘুমিয়ে সে জেগেছে সকাল সাতটায়। পাক্কা পাঁচ ঘণ্টা ঘুমের চক্র পূরণ করতে সে মোটেও ভুল করেনি, কিন্তু তার ট্রেন তত সাড়ে সাতটায়। আধ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্তুত হয়ে তাকে থাকতে হবে স্টেশনে। এই আধ ঘণ্টার মধ্যে তার সে কী ছুটোছুটি!