সালাতকে জীবনের কম্পাস বানিয়ে নিয়ে, জীবনটাকে একটা নির্দিষ্ট ফ্রেমে নিয়ে আসুন। জীবন বড়োই সংক্ষিপ্ত এক সফরের নাম। জীবনের এই অপর্যাপ্ত সময়গুলো যেন অকাজে নষ্ট না হয়।
১৪. ভালোবাসা ভালোবাসি
এক.
মুআয ইবনু জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অত্যন্ত প্রিয় একজন সাহাবি। নবিজি তাকে এত পছন্দ করতেন যে, কোথাও যাওয়ার সময় মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে সাথে নিয়ে নিজের বাহনে। চেপে বসতেন।
একদিন মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাত ধরে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘মুআয, আল্লাহর শপথ আমি তোমাকে ভালোবাসি৷’[1]
নবিজি ভালোবাসেন মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে। যাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বাছাই করেছেন মানবতার দূত হিশেবে, গোটা সৃষ্টি-জগতের জন্য যাকে রহমত হিশেবে পাঠানো হয়েছে, সপ্ত আসমানের ওপারে ডেকে নিয়ে যার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন স্বয়ং বিশ্ব জাহানের অধিপতি–সেই মহা-মানব যখন কারো হাত ধরে বলেন, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’, একবার ভাবুন তো একজীবনে সেই প্রাপ্তিটা তখন কত বিশাল হয়ে দাঁড়ায়?
মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু সম্মানিত সেই মহা-সৌভাগ্যবানদের একজন!
তবে ভালোবাসার কথা জানিয়েই কিন্তু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দায়িত্ব শেষ করেননি। ভালোবাসার কথা জানানোর পর মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে তিনি এমন কিছু শিখিয়ে দেন, যা তাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছেও করে তুলবে মহা-সম্মানিত।
মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মুআয, আল্লাহর শপথ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে বলছি, প্রতি সালাতের শেষে–আল্লাহুম্মা আ’ইন্নি ‘আলা যিকরিকা, ওয়া-শুকরিকা, ওয়া হুসনি ইবাদাতিক’ বলতে যেন কখনোই না ভুলো।[২]
ধরুন, কেউ এসে আপনাকে বললো, ‘ভাই, আল্লাহর কসম করে বলছি আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার একটা কথা শোনো, প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আধা-ঘণ্টা হেঁটে আসার কথা যেন কখনোই ভুলো না।
এই কথা যদি কেউ এসে আপনাকে বলে, তার ভালোবাসার ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ আপনার থাকে না। সে আপনাকে এমনকিছু বাতলে দিচ্ছে, যা সত্যই আপনার জন্য উপকার বয়ে আনবে। প্রত্যহ ভোরবেলা স্নিগ্ধ বাতাসে আধ-ঘণ্টা হাঁটার অভ্যাস করতে পারাটা হতে পারে আপনার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটা অর্জন। আপনার শরীর, দেহ আর মনের জন্য তা নিঃসন্দেহে অতীব উপকারী। আপনি জানেন এই দাবিতে তার কোনো স্বার্থ নেই, তার কোনো অভিপ্রায় নেই।
ভালোবাসার কথা জানিয়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে তেমনই একটা উপদেশ দিয়েছেন। নিঃস্বার্থ। মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুও জানেন–তার দুনিয়া ও আখিরাতকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার জন্য কতই না উপকারী সেই উপদেশ!
মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে শিখিয়ে দেওয়া নবিজির সেই দুআর বাংলা ভাবার্থটা এমন–’ইয়া আল্লাহ, আপনাকে স্মরণ করার ব্যাপারে, আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ব্যাপারে, অতি-উত্তমভাবে আপনার ইবাদত করার ব্যাপারে আপনি আমাকে সাহায্য করুন।
দুআটা খুবই ছোটো, কিন্তু ছোট্ট এই দুআর ভেতরে যেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সাথে লেগে থাকার সমস্ত উপকরণ বিদ্যমান। দুআটায় তিনটা জিনিসের জন্য সাহায্য চাওয়া হচ্ছে–
» আল্লাহকে স্মরণের ব্যাপারে।
» আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ব্যাপারে।
» অতি-উত্তমভাবে আল্লাহর ইবাদত করার ব্যাপারে।
আল্লাহর স্মরণ তথা যিকিরকে বলা হয় আত্মার খোরাক। মোহ, লোভ, হিংসা, ঘৃণা, পাপ আর পঙ্কিলতার ছোঁয়ায় আমাদের আত্মা প্রতিনিয়ত দূষিত হতে থাকে। সেই দূষিত আত্মাকে কেবল যিকির-ই পারে সতেজ আর সজীব করে তুলতে। আল্লাহর স্মরণ মুছে দেয় অন্তরের দূষণ আর তাতে এনে দেয় অনাবিল প্রশান্তি। কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন,
নিশ্চয় আল্লাহর স্মরণেই অন্তরগুলো প্রশান্ত হয়।[৩]
তরতর করে এগোতে থাকা সভ্যতায় আমাদের চিন্তাগুলো সর্বদা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। আমাদের চারপাশে তথ্য আর তত্ত্ব, জ্ঞান আর গরিমার বিপুল সমাহার। উপচে পড়া তথ্য আর তত্ত্বের দুনিয়ায় আমরা মাঝেমধ্যেই হাঁপিয়ে উঠি। জীবনের সঠিক গন্তব্য আর লক্ষ্য থেকেও হই বিচ্যুত। এমন বিভ্রান্তি আর বিরক্তির মুহূর্তগুলোতে যদি আমরা গভীরভাবে নিমগ্ন হতে পারি আল্লাহর স্মরণে, তাহলে রাহমানুর রাহিম ঠিক। ঠিক আমাদের বিচ্ছিন্ন অন্তরটাকে তার সঠিক রাস্তা চিনিয়ে দেন।
আল্লাহর স্মরণের পর দুআটায় যে জিনিসটা চাওয়া হয়েছে তা হলো–আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের ব্যাপারে সাহায্য।
মানুষ খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। সে সবসময় কী পায়নি আর কী পাচ্ছে না, তা নিয়েই হাপিত্যেশ করে, কিন্তু যা কিছু সে পেয়েছে বা পাচ্ছে, তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানোর সৌজন্যবোধ খুব কমই তার মাঝে উপস্থিত।
গ্রহ থেকে গ্রহে মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে পানি। তার আশা–যেখানে পানি থাকবে, সেখানেই পাওয়া যাবে প্রাণ ধারণের সম্ভাবনা। মঙ্গল, নেপচুন, প্লুটো আর ইউরেনাসসহ মহাশূন্যের অন্যসব জায়গায় যে পানি সোনার হরিণের মতোই দুর্লভ, সেই পানিকে পৃথিবী নামক গ্রহটায় আমাদের জন্য কত সহজলভ্য করেছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা; কিন্তু আমরা কি এই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করি? কখনো দুআয় দুহাত তুলে আল্লাহকে বলেছি, ইয়া আল্লাহ, গোটা মহাবিশ্বে যা অপ্রতুল, তা কত অনায়াসে আপনি আমাকে দান করছেন নিত্যদিন। যে নিয়ামত না হলে আমার বাঁচা অসম্ভব হতো, না-চাইতেই তা কত অবলীলায় আমি পেয়ে যাচ্ছি। এই যে নিয়ামত আপনি আমাকে দান করছেন, এর জন্য আপনার দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া।