কারো কারো জন্য এটা বেশ কঠিন কাজ। পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের রাতেই যেখানে স্বাভাবিক ঘুম হয় না, সেখানে দিনে চোখ ভেঙে ঘুম নামানো যে বেশ শ্রমসাধ্য এবং সাধনাল ব্যাপার-ই হবে, তা তো অবশ্যই। যদি আপনি দুপুরের এই হালকা ঘুমে। অভ্যস্ত না হোন, তাহলে আপনার জন্য আমার দ্বিতীয় বিকল্প পরামর্শ হচ্ছে–এই সময়টায় আপনি ভালো কোনো বই, সেটা হতে পারে ইসলামের ইতিহাসের কোনো বই কিংবা আমলের অথবা ইসলামিক কোনো ফিকশন নিয়ম করে পড়তে পারেন। এই সময়টুকুতে প্রতিদিন দশ বা পনেরো পৃষ্ঠা কিংবা নিদেনপক্ষে পাঁচ পৃষ্ঠা পড়ার একটা দৈনিক অভ্যাস গড়ে তুলুন। এতে করে যদি দৈনিক দশ পৃষ্ঠা পড়া যায়, তাহলে মাস শেষে আপনার তিনশো পৃষ্ঠার যেকোনো ঢাউস সাইজের বই পড়া হয়ে যাবে অনায়াসে। আগে যে সময়টা আপনি হয়তো-বা বেহুদা গল্প-গুজব কিংবা ফেইসবুকে কাটাতেন, এখন সে সময়টাকে কাজে লাগিয়ে মাসে অন্তত একটা ভালো বই আপনি পড়ে শেষ করতে পারছেন।
আসরের পরের সময়টুকু সাধারণত আমাদের নিয়মতান্ত্রিক অলসতায় কাটে। সারাদিনের ক্লান্তি, দৌড়ঝাঁপ শেষের এই সময়টা যেন গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠার আগেই ফুরিয়ে যায়। আমাদের শরীর ও মনকে চাঙা রাখতে এই সময়ে আমরা ভিন্ন কিছু করতে পারি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা কিংবা কফি হাতে, আদিগন্ত নীলাকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা তলিয়ে যেতে পারি ভাবনার অতলে। আকাশের রংধনু, পাখিদের ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে আমরা উপভোগ করতে পারি অবসরের অবশিষ্ট সময়টুকু। সবুজের সান্নিধ্যে যাওয়ার সাধ্য যাদের আছে, বাগানে পায়চারি করা, কিংবা শান বাঁধানো পুকুর-ঘাটে বসে নিজের আদি এবং আসল গন্তব্যের কথা স্মরণ করে কাটাতে পারি পড়ন্ত বিকেলের এই স্বল্প সময়।
সময়টা পরিবারের সাথেও কাটানো যায়। কাজের চাপে কত দিন মনখুলে কথা বলা হয় না মায়ের সাথে। বাবার সাথে শেষ কবে গল্প-আড্ডায় মেতে উঠেছি মনে করা কঠিন। স্ত্রী-সন্তানদের সাথেও গড়পড়তা কথাবার্তা ব্যতীত আলাপ হয় না। তাই অবসরের এই সবটা সময়, আমরা ইচ্ছে করলে আমাদের পরিবারের জন্য বরাদ্দ করতে পারি।
এর বাইরেও যে-সকল আত্মীয়স্বজনের সাথে সময় স্বল্পতার কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে, এই সময়টাতে আমরা তাদের সাথেও সংযুক্ত হতে পারি নতুনভাবে। টেলিকমিউনিকেশনের এই যুগে, এই কাজ করতে আমাদের নিশ্চয় না। খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। এতে করে আমাদের প্রায়-বিলুপ্ত আত্মীয়তার বন্ধনগুলো সুদৃঢ়, মজবুত হয়ে ওঠবে। টার্গেট করা যায়–আগামি ত্রিশ দিনে এই সময়টাতে আপনি অন্তত ত্রিশজন আত্মীয়ের সাথে কথা বলবেন।
অথবা এর কোনোটাই যদি সম্ভব না হয়, আপনি নতুন আরেকটা টার্গেট নিজের জন্য তৈরি করে নিতে পারেন। আপনি যদি স্থির করেন, প্রতিদিন আসরের পরের এবং মাগরিবের আগের সময়টুকুতে অন্তত একটা করে দুআ শিখবেন, তাহলে মাস শেষে দেখা যাবে আপনি গুনে গুনে ত্রিশটা এমন দুআ শিখে ফেলেছেন, যা আপনি আগে জানতেন না। দুআ আমাদের জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আর সেই দুআ যদি হয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার শিখিয়ে দেওয়া, নবি-রাসুলগণের মুখনিঃসৃত, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! প্রতিদিনকার হেলায় নষ্ট করা সময় থেকে কিছু সময় বাঁচিয়ে যদি আমরা আখিরাতের কাজে লাগাতে পারি, তার চাইতে বড় অর্জন আর কিছু হতে পারে কি?
মাগরিবের পরের সময়টুকুর কথা যদি বলি, আমাদের সাধারণ বাঙালি পরিবারগুলোতে এই সময়টা বিভিন্ন টিভি সিরিয়াল, টিভি-শো দেখতে দেখতেই পার হয়ে যায়; তবে একজন সচেতন মুসলিম নিজেকে এসব থেকে সতর্কতার সাথে বাঁচিয়ে রাখে। তাই এই সময়টাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে আমরা আমাদের কাজগুলোকে গুরুত্ব অনুযায়ী ভাগ করে নিতে পারি। যাদের পড়াশোনা আছে, এই সময়টায় পড়াশোনায় মন দেওয়া যায়। লেখালেখি যাদের কাজ, তারা এই সময়টায় লেখালেখিতে ডুব দিতে পারেন। সময়টা বই পড়ে, বাসার কাজকর্ম করেও কাটানো যায়।
ইশার সালাতের পরের সময়টা আমরা সাধারণত ফেইসবুকে কাটাই। ফেইসবুক এমন এক আজব জিনিস, যেখানে আমরা পাঁচ মিনিট থাকার সংকল্প নিয়ে ঢুকি, পাঁচ ঘণ্টা চলে যাওয়ার পরে আমাদের বোধোদয় ঘটে। এই বাজে অভ্যাস থেকে আমাদের দ্রুতই বেরিয়ে আসতে হবে। ফেইসবুক যেহেতু জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়ে গেছে এবং একে বাদ দিয়ে চলাটা একপ্রকার অসম্ভব, তাই। এর ব্যবহার সীমিতকরণ করা খুব জরুরি; নয়তো আমাদের প্রোডাক্টিভিটিকে অঙ্কুরে বিনাশ হতে দেখা ছাড়া আমাদের হাতে করার আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।
ইশার সালাতের পরে হাতে ভারী কোনো কাজ না রাখাই উত্তম। ভারী কাজ করতে গিয়ে যদি ঘুমোতে দেরি হয়ে যায়, তাহলে ফজরের সালাতের জন্য জাগাটা কষ্টকর হয়ে ওঠে। ফজরের সালাতের গুরুত্ব একজন মুমিনের জীবনে সর্বাধিক।
অধিকতর হালকা কাজগুলো এই সময়ে করার জন্য আমরা রাখতে পারি, যেমন : পত্রিকা, ম্যাগাজিন বা কোনো বই পড়া, শিশুদের দ্বীনি ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা, পরিবারের সকলের সাথে দ্বীন নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা ইত্যাদি।
সারকথা হলো–আমাদের যার যা কাজ, সেই কাজ অনুযায়ী পাঁচ ওয়াক্ত সালাতকেন্দ্রিক একটা নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া। সালাতকে কেন্দ্রে রেখে জীবনটাকে সাজাতে পারলে আমাদের ভেতরে একটা তাড়না কাজ করবে। নিজেকে সমৃদ্ধ করার তাড়না। সালাতগুলো আমাদের একটা রিমাইন্ডার দেবে। আমাদের মনে হবে-যুহরের পরে তো আমার দশ পৃষ্ঠা বই পড়তে হবে, ‘আসরের পর তো আমার অমুক দুআটা শিখতে হবে’, ‘মাগরিবের পর তো অমুককে ফোন করতে হবে।’