জীবনে সফল হতে হলে সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর চাইতে দ্বিতীয় কোনো ভালো বিকল্প আমাদের সামনে নেই। মৃত্যুর আগে আমাদের আল্লাহর প্রিয় হয়ে উঠতে হবে। তার মানে, মৃত্যু চলে আসার আগের সময়টাকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে। অনেক বেশি আমল করতে হবে। এজন্য সময়কে কাজে লাগাতে হবে। বাড়তি আমলের জন্য বাড়তি সময় বের করতে হবে। ধীরে ধীরে, খুশু-খুযুর সাথে সালাত আদায় করতে হবে। মানে সময় নিয়ে, ধীরস্থিরভাবে সালাত আদায় করতে হবে। তাড়াহুড়ো করা যাবে না। ইসলামি জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তার জন্য ইসলামি বইপত্র পড়তে হবে। কুরআন-হাদিস-তাফসির-সিরাহ পড়তে হবে। এরজন্য তো সময় দরকার। সময় বের করতে হবে। অকাজের সময়কে কাজে পরিণত করতে পারতে হবে।
অর্থাৎ, আমরা যা-ই করি না কেন, সময় কিন্তু কোনোভাবেই আমাদের পিছু ছাড়ছে না। আমাদের বাঁচতে হয় সময়ের মাঝে, সময়ের মধ্যে, সময়কে নিয়ে। তাই বলা । হয়–’Time is very mystical character. If you use it properly, it’ll be your best companion. If you misuse it, it’ll be your worst enemy’.
দুই.
তাহলে সময়কে আমরা কাজে লাগাবো কীভাবে? আমরা যারা ইসলাম প্র্যাক্টিস করি, সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে, আমাদের জন্য সবচাইতে ভালো উপায় হচ্ছে ‘সালাতকেন্দ্রিক জীবনযাপন। সালাতকে জীবনের কম্পাস বানিয়ে, সেই অনুযায়ী আমাদের জীবনকে আবর্তিত করা গেলে সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানো আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতকে আমাদের জন্য ফরয। করেছেন, তা আমরা সবাই জানি। এই পাঁচ ওয়াক্তের সালাতকে পাশ কাটানোর কোনো সুযোগ আমাদের সামনে নেই। আগেও বলেছি, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত হলো আমাদের জন্য অক্সিজেন গ্রহণের মতো। অক্সিজেন গ্রহণ না করলে যেমন আমাদের দেহের মৃত্যু ঘটবে, ঠিক সেভাবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ছেড়ে দিলে মৃত্যু ঘটবে আমাদের আত্মার। তাই অক্সিজেন গ্রহণ করার মতন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ও আমাদের জন্য জরুরি। অবশ্য কর্তব্য।
এখন সালাতের বাইরে আমাদের যাবতীয় যা কাজ, সেই কাজগুলোকে আমরা সালাতের সময়ানুযায়ী ভাগ করে নিতে পারি। আমি যদি ঠিক করি, এই মাসে আমি সুরা বাকারার অনুবাদ আর তাফসির পড়ে শেষ করবো-ই করবো, তাহলে ফজরের পরের যে সময়টুকুতে সাধারণত আমার ঘুমোতে মন চায় কিংবা আমি ঘুমোই, ওই সময়টাকে আমি চাইলেই সহজে কাজে লাগাতে পারি। এখন থেকে ফজরের পর আমার আর ঘুমোনো চলবে না। ঘুমোনোর সময়টাকে যেহেতু আমি আমার পড়াশোনার জন্য বরাদ্দ করেছি, তাই এই সময়টাতে আমার চোখজুড়ে যত ঘুমই নামুক, নরম বিছানা যতই লোভাতুর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকুক, আমি জানি যেকোনো উপায়েই হোক, আমাকে এই ডাক, এই আহ্বান উপেক্ষা করতে হবে। চোখ থেকে ঘুম তাড়াতে যা যা করতে হয় করবো। হাঁটাহাঁটি করা, চা-কফি পান করা, ব্যায়াম বা শরীরচর্চা–যেকোনো উপায়েই আমাকে জেগে থাকতে হবে আমার লক্ষ্য পূরণের জন্য। শুধু যে গড়গড় করে পড়ে চলে গেলে হয়ে যাবে, তা কিন্তু নয়। সুরা বাকারা থেকে নতুন এবং শিক্ষণীয় বিষয়গুলো, যেগুলোকে আমার জীবনোপকরণের, জীবন-গঠনের জন্য দরকারি মনে হবে, সেগুলোকে রঙিন পেন্সিল বা মার্কার দিয়ে দাগিয়ে, নোট করে করে আমি এগোতে পারি। সচেতন পাঠক-মাত্রই বুঝে ফেলবেন এই পদ্ধতির কার্যকারিতা।
এভাবে সুরা বাকারা শেষ হলে অন্য যেকোনো সুরা, যা আমার জন্য বোঝা জরুরি এবং তা অনেক সহজও, এমন অন্য একটা সুরা নিয়ে বসে পড়তে পারি অথবা এমনও হতে পারে–এই মাসে সুরা বাকারা শেষ করলাম তো পরের মাসে সিরাহ তথা নবিজির জীবনী নিয়ে বসে গেলাম। লক্ষ্য হবে একমাসের মধ্যে অন্তত নবিজির হিজরত পর্যন্ত পড়ে ফেলা। পরের মাসে হয়তো-বা বসতে পারি রিয়াযুস সালিহিন নিয়ে। মোদ্দাকথা, আমার সুবিধে অনুযায়ী আমি নির্ধারণ করে নিতে পারি, কোন মাসে কী পড়ব; তবে যা-ই পড়ি আর যেটাই পড়ি, পড়ার সিলসিলা আমাকে জারি রাখতেই হবে, এই দৃঢ় অঙ্গীকার আমার মধ্যে থাকা চাই।
ফজরের পরের যে সময়টা এত দিন আমার অলস কাটতো, কোনো কাজ না পেয়ে এত দিন যে সময়গুলোতে আমি নাক ডেকে ঘুমোতাম, সেই সময়গুলো এখন থেকে প্রোডাক্টিভ কাজে লাগছে।
অফিস অথবা স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যারা পড়ে কিংবা পড়ায়, তাদের হাতে ফজরের পরের এই সময়টুকু ছাড়া অতিরিক্ত সময় সাধারণত থাকে না। যেহেতু অফিস গমন কিংবা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে আর কোনো সময় হাতে অবশিষ্ট থাকছে না, আপনাকে দেখতে হবে যুহরের পরের সময়টুকু আপনার কীভাবে কাটে। আমার মতে–যুহরের সালাত, খাওয়া এবং আনুষঙ্গিক কাজের জন্য আমাদের দেশে ভালো রকমের একটা বিরতি নির্ধারণ করা থাকে। সালাত আদায় এবং খাওয়া-দাওয়ার বাইরে যেটুকু সময় হাতে থেকে যায়, সেই সময়টুকু আপনি চাইলে দুইভাবে কাজে লাগাতে পারেন। যদি ঘুমোনোর অভ্যাস থাকে এবং পর্যাপ্ত বন্দোবস্তও থাকে, তাহলে আমার পরামর্শ হবে এই সময়টায় আপনি হালকা ঘুমিয়ে নিন। গভীর কোনো ঘুম নয় কিন্তু। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখুন। বিশ মিনিট বা আধ ঘণ্টার। যদি ঘুম নাও আসে, তথাপি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। আপনার মস্তিষ্ককে একটু স্থির হতে দিন।