‘তাদের পরে এলো এমন এক অসৎ জাতি, যারা সালাত বিনষ্ট করলো এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করলো।’[5]
তারা অভিশপ্ত হয়েছিলো, জীবনের ছন্দ হারিয়েছিলো কেবল সালাত বিনষ্ট করে। সালাত বিনষ্ট করায় তারা আপনাআপনি ঢুকে পড়েছে কুপ্রবৃত্তির মায়াবৃত্তে। সেই বৃত্ত থেকে তারা আর বেরোতে পারেনি। তারা হয়েছে পথভ্রষ্ট। আজ আমরা যারা জীবনের ছন্দ হারিয়ে হাপিত্যেশ করছি, জীবনের গতিপথ মন্থর হয়ে যাওয়ায় যারা সমাধানের রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছি, আমাদের কি একটু সময় হবে সালাতগুলোর ব্যাপারে চিন্তা করার? যাপিত জীবনের দৈনন্দিন রুটিনে সালাতটাকে ‘অবশ্যকর্তব্য’ করে নেওয়ার ব্যাপারে একটু মনোযোগী কি আমরা হতে পারি না? বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ না করলে আমাদের অস্তিত্ব যেমন সংকটে পড়ে যাবে, ঠিক সেভাবে সালাতের ব্যাপারে উদাসীনতা মন্থর করে দেবে আমাদের জীবনের সকল ছন্দ, সকল গতিময়তাকে। তাই, কুপ্রবৃত্তির ধোঁকার মাঝে আর হাবুডুবু খাওয়া নয়। আর নয় রোজকার অগোছালো জীবন। আজ, ঠিক এই মুহূর্ত থেকে চলুন আমরা হয়ে উঠি এক অন্য মানুষ। আমাদের জীবনকে আমরা রাঙিয়ে তুলি সালাত দিয়ে। আর রাঙিয়ে তুলি আমাদের দুনিয়া-আখিরাত–দুটোই।
তিন.
জীবনে কি এমন হচ্ছে যে, কোথাও কোনো সফলতা পাচ্ছেন না? মনে হচ্ছে যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই ব্যর্থতা আপনাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য ওত পেতে আছে? পরীক্ষায় আশানুরূপ সফলতা আসছে না, বারবার ব্যবসায় লোকসান গুনছেন, একটা ভালো চাকরির আশায় দিনের পর দিন অপেক্ষার প্রহর গুনছেন, কিন্তু কোনোভাবেই একটা চাকরির বন্দোবস্ত হচ্ছে না। সংসার থেকে যেন বারাকাহ উঠে গেছে। আয়-রোজগারে খুব মন্দা পরিস্থিতি। হয় এমন?
আচ্ছা, কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কেন এমন হচ্ছে? কেন আপনি বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন? কেন সফলতা হাতছানি দিয়েও দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে? কেন আপনার সংসারে আগের সেই বারাকাহ, আগের সেই স্থিতিশীলতা আপনি এখন পাচ্ছেন na? কেন আপনার ব্যবসার পুঁজি, শ্রম, সময়ের বিনিয়োগ আগের চেয়ে ভালো হওয়া সত্ত্বেও আপনি সাক্ষাৎ পাচ্ছেন না সফলতার? কখনো খতিয়ে দেখেছেন শূন্যতাটা আসলে কোথায়?
আপনার এই ব্যর্থতার একটা সম্ভাব্য কারণের উল্লেখ পাওয়া যাবে কুরআনে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন–
আর (আমার রব) আমাকে বানিয়েছেন আমার মায়ের প্রতি অনুগত; এবং তিনি আমাকে অবাধ্য, হতভাগ্য করেননি।[6]
আয়াতের কথাগুলো ঈসা আলাইহিস সালামের, যখন তিনি মায়ের কোলে থাকাবস্থাতেই তার গোত্রের লোকজনের সাথে কথা বলেছেন। এই আয়াতে তিনি তার গোত্রের লোকদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আমার রব আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত বানিয়েছেন। মায়ের অনুগত মানে কী? মায়ের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, মায়ের হকের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া। মায়ের অবাধ্য না হওয়া, মায়ের দেখভাল করা, মায়ের প্রতি রূঢ়, বিরূপ আচরণ না করা, মায়ের মনোবাঞ্ছ, মনোবাসনা পূরণ করা ইত্যাদি মায়ের অনুগত হওয়ার অন্তর্ভুক্ত। ঠিক এরপরেই ঈসা আলাইহিস সালাম বললেন, তিনি আমাকে বানাননি অবাধ্য, হতভাগ্য।
আয়াতটির দুটো অংশ। প্রথম অংশে মায়ের অনুগত হওয়ার কথা, দ্বিতীয় অংশে অবাধ্য না হওয়া এবং হতভাগা না হওয়ার কথা।
এই আয়াতে ‘হতভাগ্য’ বলতে আরবি ‘শাক্বিইয়া’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ–বিফল হওয়া, ব্যর্থ হওয়া, অসফল হওয়া। Lack Of Success এই একই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে একই সুরার ৪ নম্বর আয়াতে, যেখানে যাকারিয়া আলাইহিস সালাম দুআর মধ্যে বলছেন, হে আমার রব, আমি তো কখনো আপনাকে ডেকে ব্যর্থ হইনি।
আয়াতটি থেকে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় যে–ঈসা আলাইহিস সালাম মায়ের অনুগত হওয়ার দাবি উত্থাপনের ঠিক পরেই বললেন, তাকে ব্যর্থ বা অসফল বানানো হয়নি। তাহলে, মায়ের আনুগত্যের সাথে সফল হওয়া না-হওয়ার একটা সম্পর্ক প্রতীয়মান হচ্ছে না এখানে? এটাই হচ্ছে এই আয়াতে কুরআনের বার্তা।
এবার তাহলে নিজেদের জীবনের দিকে একটু তাকানো যাক। এই যে জীবনজুড়ে অসফলতার ছড়াছড়ি, ব্যর্থতার সকরুণ গল্প, এই ব্যর্থতা ঠিক কী কারণে আপনার ওপর নিপতিত হয়েছে, তা কি খুঁজে বের করা উচিত নয়? যদি জিজ্ঞেস করি– মায়ের সাথে আপনি কি যথাযথ আচরণ করেন? মায়ের হকগুলোর ব্যাপারে, মায়ের অধিকারগুলোর ব্যাপারে আপনি কি সর্বদা তৎপর ছিলেন বা আছেন? আপনি কি মায়ের সাথে গলা চড়িয়ে কথা বলায় সিদ্ধহস্ত? তার মতামতকে, তার আবদারকে অগুরুত্বপূর্ণ মনে করে আপনি কি সহজেই উড়িয়ে দেন? আপনি কি মায়ের চাহিদাগুলোর যথেষ্ট মূল্যায়ন করেন?
এই জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর যদি না হয়, তাহলে আজই আপনার মায়ের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত। যে ভুল আপনি গর্ভধারিণী মায়ের সাথে করে এসেছেন, যে অশোভন আচরণে আপনি বারংবার ক্ষত-বিক্ষত করেছেন তার অন্তর, সমস্ত কিছুর জন্য তার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চান। পা জড়িয়ে ধরে কাঁদুন। ছোটোবেলায় যেভাবে তার আঁচল-তলে লুকোতেন, তার গলা জড়িয়ে কাঁদতেন, ঠিক সেভাবে। বিশ্বাস করুন আপনার ব্যর্থতার কারণ ঠিক এখানেই লুকিয়ে আছে। এখানে এসেই আপনি বারবার হেরে যাচ্ছেন। আপনার জীবনে বারাকাহর যে ঘাটতি, তার শুরুটা ঠিক এখান থেকেই।