উঁহু, ঠিক তা নয়। অভিপ্রায় তো একটা আপনার থাকাই লাগবে। কেন আপনি মানুষের ভালো চাইবেন, কেন শত্রুর বিপদেও পাশে দাঁড়াবেন, কেন উপকারের বাসনা নিয়ে ছুটে যাবেন মানুষের দ্বারে, তার কারণ আপনার রব আপনাকে জানাচ্ছেন–
মানুষের কল্যাণ করো, যেভাবে আল্লাহ তোমার কল্যাণ করেন।[৬]
কে আপনার অকল্যাণ সাধন করলো, কে আপনার দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ালো না, কে আপনার পেছনে শত্রুতা করেছিলো–এসবকিছুর জন্য আপনার জীবন কিন্তু থেমে থাকেনি। সেই অকল্যাণ থেকে, সেই দুঃসময় থেকে, সেই শত্রুতা থেকে কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আপনাকে ঠিকই উদ্ধার করে নিয়ে এসেছেন। তাই, কারো উপকার করার জন্য সে আপনার জন্য কী করেছে’–তা কখনো বিবেচনায় রাখবেন না। সকল প্রতিকূলতার বিপরীতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার যে দয়া আর সাহায্য আপনি পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন–মানুষের ঘৃণা, অসহযোগিতা আর অসহিষ্ণুতার তুলনায় সেসব নিয়ামত অনেক অনেক বিশাল!
মানুষ যে দুঃখগুলো আপনাকে দেয়, সেগুলো মনে রাখুন, তবে দুঃসময়ে সেগুলো টেনে তাদের ঘায়েল করবার জন্য নয়। মুনাজাতে আল্লাহর কাছে বলবার জন্য যে ‘ইয়া আল্লাহ, আমার দুঃসময়ে আমি তাকে পাশে পাইনি, কিন্তু আপনি ঠিক-ই আমার পাশে ছিলেন। এখন তার দুঃসময়ে আপনি আমাকে তার মতো বানাবেন না। আমার অন্তরকে তার মতো সংকীর্ণ করে দেবেন না। তার বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাওফিক আপনি আমাকে দান করুন, ইয়া রব।
আপনার হৃদয়ের জানালাটা সবার জন্য খুলে দেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর দয়ার ভান্ডার আপনার জন্য উন্মুক্ত করে দেবেন।
———–
[1] সুরা নুর, আয়াত : ২২
[2] সহিহুল বুখারি : ৪১৪১; সহিহ মুসলিম : ২৭৭০; তাফসিরুল বাগাভি, খণ্ড : ৬, পৃষ্ঠা : ২১; কুরতুবি, খণ্ড :১২, পৃষ্ঠা : ২০৭; তাবারি, খণ্ড : ১৯, পৃষ্ঠা : ১২৩; তাফসির ইবনু আবি হাতিম, খণ্ড : ৮, পৃষ্ঠা : ২৫৪৩; দালাইলুন নুবুওয়াহ, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৭১
[3] সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৯২
[4] সহিহুল বুখারি : ৩২৩১; সহিহ মুসলিম : ১৭৯৫; দালাইলুন নুবুওয়াহ : ২১৩; রিয়াযুস সালিহিন : ৬৪২
[5] সহিতুল বুখারি : ৩২৩১; সহিহ মুসলিম : ১৭৯৫; সহিহু ইবনি হিব্বান : ৬৫৬১; মুসনাদুল বাযযার :১০৩
[6] সুরা কাসাস, আয়াত : ৭৭
১৩. জীবনের কম্পাস
এক.
আমাদের আগাগোড়া জীবনটাকে যদি পরখ করি, তাহলে অবাক বিস্ময়ে দেখতে পাবো, আমাদের জীবনে যা কিছু লাভ-ক্ষতি, যা কিছু প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, প্রায় সবকিছুর মূলে প্রথম এবং প্রধান নিয়ামক হিশেবে যা ছিলো তা হচ্ছে–সময়।
যে ছাত্রটা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে, তার অকৃতকার্যের কারণ অনুসন্ধান করলে আমরা দেখতে পাবো–সে পরীক্ষার আগের সময়গুলোকে ভালোভাবে কাজে লাগায়নি। নিয়মিত এবং নিয়মমাফিক পড়াশোনা করেনি।
যে ব্যবসায়ী ব্যবসায়ে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে, তার কেইস স্ট্যাডি যদি আমরা সামনে রাখি, তাহলে আমরা দেখবো–তার ক্ষতির পেছনে যতগুলো কারণ বেরিয়ে আসছে, সবখানে কোনো না কোনোভাবে সময় জড়িত। হয়তো সে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, যার কারণে মার্কেটে সে টিকতে পারলো না অথবা এমনও হতে পারে–সঠিক সময়ে পণ্যের জোগান দিতে তার প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু তার এই জায়গাটা তার-ই মতো অন্য কোনো ব্যবসায়ী দখল করতে সমর্থ হয়েছে কেবল সঠিক সময়ে পণ্যের জোগান দিতে পারার ফলে।
যে লোকটা ট্রেন মিস করেছে, আমরা যদি তার ট্রেন মিসের কারণ জানতে চাই, সেও আমাদের সময়ের কথা জানাবে। সঠিক সময়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে স্টেশানে ।আসতে না পারায় গন্তব্যের ট্রেন তাকে ছেড়ে চলে গেছে।
মোদ্দাকথা, জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, জীবনের প্রতিটা অর্জন আর ব্যর্থতাকে যদি আমরা নিক্তিতে ফেলে পরিমাপ করি, তাহলে আমরা দেখতে পাবো–আমাদের জীবনের সবটা জুড়ে যা সত্য ও সৃতঃসিদ্ধ হয়ে আছে, তা হলো সময়। সময় মানুষকে গড়ে এবং সময়-ই মানুষকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। ঠিক এজন্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সুরা আসরে সময়ের শপথের পর পরই, আমরা যে আদতে ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত আছি, তা আমাদের স্পষ্ট করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সময় হচ্ছে এমন এক অস্পশ্য বস্তু, যা স্পর্শ করা যায় এমন সবকিছুকে হয় পূর্ণ করে তোলে, নতুবা তাতে মেখে দেয় অপূর্ণতার গ্লানি।
সময় এমন এক নিরেট ‘বাস্তববাদী বন্ধু, যে মুহূর্তের অবহেলায় পরিণত হতে পারে সবচেয়ে জঘন্য শত্রুতে। একজন মানুষ একজীবনে সবচেয়ে বেশি যে জিনিস অপচয় করে, তা হলো সময়। আর সময় এমন এক সম্পদ, যা একবার হারালে, ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য। সময় অপচয় করে একজীবনে একজন মানুষ সবচেয়ে বড় যে নিয়ামত হারাতে পারে, তা হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নৈকট্য। কারণ সময়ের ব্যাপারে সচেতন না হলে তার দুনিয়া যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার আখিরাতও। এইজন্যই ইমাম ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, সময়ের অপচয় মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ, কেননা মৃত্যু মানুষকে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে, আর সময় অপচয় মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় তার রব থেকে।