ভাবুন তো, কারো দুঃখের দিনে আপনি আপনার সর্বোচ্চটা দিয়ে তার পাশে দাঁড়ান, কিন্তু দিনশেষে যদি জানতে পারেন, সেই লোকটা আপনার মান-ইজ্জতকে দুই পয়সারও দাম দেয় না, সুযোগ পেলে আপনার পিঠে ছুরিও চালিয়ে দিতে পারে, আপনার অবস্থা তখন কেমন হবে? আপনি নিশ্চয় এতে অনেক দুঃখ পাবেন। ভাববেন, খাল কেটে আপনি হয়তো কুমির আমদানি করেছেন এত দিন অথবা দুধ-কলা দিয়ে পুষে এসেছেন বিষধর কালসাপ। যার জন্য আপনি গলা-পানিতে নামতে রাজি, সে যদি ওই পানিতেই আপনাকে ডুবিয়ে মারতে চায়, আপনার মনের অবস্থা তখন কেমন হবে?
আপনি বলবেন, না! তোমার সাথে আর না। আমি হাড়ে হাড়ে চিনতে পেরেছি। তোমাকে। আমার নুন খেয়ে আমারই বদনাম করে বেড়াও, আর ভেবেছো কিনা। তোমাকে আমি এভাবেই সাহায্য করে যাবো? এত সস্তা দুনিয়া?
তাকে এত দিন যা সাহায্য-সহযোগিতা আপনি করতেন, সব বন্ধ করে দেবেন মুহূর্তেই। আর যাই হোক, একজন বিশ্বাসঘাতকের সাথে আর কোনো সম্পর্ক আপনি রাখতে পারেন না।
আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহার ঘটনায় দূর সম্পর্কের সেই আত্মীয়ের ব্যাপারেও মুহূর্তের জন্য এভাবে ভেবেছিলেন আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বললেন, ‘নিয়মিতভাবে তোমাকে যে সাহায্য-সহযোগিতা আমি করতাম, সেটা আজ থেকে বন্ধ করলাম। আমার কন্যার ব্যাপারে যে তোক এতটা অপবাদ দিতে পারে, তার জন্য আমার কোনো দয়া থাকতে পারে না।
একজন মানুষ হিশেবে, একজন বাবা হিশেবে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর এই চিন্তাটা খুবই স্বাভাবিক। আপনি বা আমি হলেও এর ব্যতিক্রম চিন্তা কখনোই করতে পারতাম না, কিন্তু আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর এই চিন্তাটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পছন্দ করলেন না। কেউ একজন আপনার সাথে অন্যায় করেছে বলে তার। সাথে যাবতীয় সম্পর্ক আপনি ছিন্ন করে আসবেন, দুঃসময়ে তাকে দিয়ে আসা সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ করে দেবেন–এমনটা করবার ব্যাপারে ইসলাম আপনাকে উৎসাহিত করে না। আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর এমন সিদ্ধান্তের বিপরীতে তাকে সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনের আয়াত নাযিল করলেন–
‘তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা ও প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন শপথ করে না বসে যে, তারা আত্মীয়স্বজন, মিসকিন এবং আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের সাহায্য করবে না। তারা যেন তাদের ক্ষমা করে দেয় ও তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি উপেক্ষা করে। তোমরা কি পছন্দ করো না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেন? আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু৷৷’[১]
আল্লাহ বলছেন–আমাদের মধ্যে যাদের মর্যাদা ও প্রাচুর্য আছে, আমরা যেন কখনোই আমাদের আত্মীয়স্বজন, দরিদ্র এবং আল্লাহর রাস্তায় হিজরতকারী, আমাদের সাহায্য যাদের অতীব দরকার, তাদের যেন আমরা উপেক্ষা না করি। হতে পারে আমাদের কোনো বিপদের সময়ে তারা আমাদের পাশে ছিলো না। হতে পারে তাদের জন্যই আমাদের পার করতে হয়েছে কোনো ভয়ংকর দুঃসময়। হতে পারে আমাদের সাথে তারা ভারি অন্যায়-অবিচার করেছে কোনো একদিন। কোনো একটা সময়ে তাদের কাছে হাত পাতলেও তারা হয়তো আমাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি।
আল্লাহ বলছেন–তাদের সেই অন্যায়ের, তাদের সেই অবিচারের, সেই। আত্মকেন্দ্রিকতা এবং হিংসুটে মনোভাবের হিশেব যেন আমরা না করি। সেগুলোকে হৃদয়ে টুকে রেখে তাদের দুঃসময়ে যেন আমরা প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে না উঠি। তাদের ভুল, তাদের অবিবেচকতা, তাদের অন্যায় যেন আমাদের এমন কোনো কাজের দিকে ধাবিত না করে, যেখানে তাদের আর আমাদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই; বরং ভুলকে ভুলে গিয়ে, আমাদের দয়া, উদারতা আর প্রশস্ত হৃদয় যেন আমরা নিবেদন করতে পারি তাদের দিকে।
এতে কী হবে জানেন?
ওই একই আয়াতে আল্লাহ বলছেন–’তোমরা কি চাও না যে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিন?
যে আপনার ক্ষতি চায়, যে আপনার সাথে শত্রুতা করে, যে আপনার ভালো সহ্য করতে পারে না, তার উপকার করা মানে যে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া, তার কাছে হেরে যাওয়া, তা কিন্তু নয়। এতে বরং আপনার লাভের পরিমাণটাই বেশি। একটা শাশ্বত মানবজীবনের উদাহরণ আপনি তার সামনে এবং সমাজের সামনে স্থাপন করতে পারবেন। সত্যিকারের বীরপুরুষ তো তারাই, যারা ক্ষমতা হাতে পেলে বিনয়ী হয়। প্রতিশোধের সমস্ত সুযোগ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যারা ক্ষমার চাদরে মুড়িয়ে নেয় জীবন–তারাই শক্তিমান। কদর্যতার বিপরীতে, হিংসা আর দ্বেষের দুনিয়ায় আপনার এহেন মহানুভবতা সমাজের অনেকের জন্য হয়ে উঠবে অনুপ্রেরণার!
তবে সবচেয়ে বড় লাভ এটা নয়। সবচাইতে বড় লাভ হলো–আপনার এই কাজের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আপনাকে ক্ষমা করে দেওয়ার ওয়াদা করেছেন। একজনের ভুলকে বড় করে না দেখে তার দুয়ারে দয়ার ঝুড়ি নিয়ে যখন আপনি উপস্থিত হবেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাও তার দয়ার ভান্ডার আপনার জন্য উন্মুক্ত করে দেবেন। আসমানে তিনি আপনার মর্যাদাকে এত উন্নীত করবেন যে, আপনার ইচ্ছে হবে, ইশ! এরকমভাবে ক্ষমা করে দেওয়ার আরো অহরহ সুযোগ, যদি দুনিয়ায় আমি পেতাম!
যে ক্ষমা করে তার কোনো ক্ষতি নেই; বরং তার জন্য আছে মহা-পুরস্কার।