তার মানে, আপনি কি ফেইসবুকে কারো লেখাই পড়বেন না? কারো কোনো ভিডিও-ই দেখবেন না? সবাইকে আনফ্রেন্ড আর আনফলো করে দেবেন?
দুঃখিত, আমাকে ভুল বুঝবেন না দয়া করে। আমি কিন্তু মোটেও তা বলতে চাইনি। আপনি অবশ্যই ফেইসবুকে আসবেন, ভালো লেখা পড়বেন, ভালো ভিডিওগুলো দেখবেন। তথ্য-বিপ্লবের দুনিয়ায় এটাও জ্ঞান বিকাশের একটা মাধ্যম, তবে ফেইসবুককে আপনি আপনার একজন ভালো বন্ধু হিশেবে নিতে পারেন।
ধরুন, আপনার বাড়ির পাশে আপনার খুব ভালো একটা বন্ধু আছে, যার সাথে আড্ডা দিলে আপনি অনেক কিছু জানতে পারেন, কিন্তু তাই বলে কি সেই বন্ধুর সাথে প্রতিদিন আপনি ছয়-সাত ঘণ্টা করে আড্ডা দেবেন? এটা আপনার ওই বন্ধু বা আপনি–দুজনের কারো জন্যই কি ভালো? আপনারা কি সর্বদা পারবেন এত লম্বা সময় আড্ডা দিতে? যদি দেন, এটা আপনাদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজগুলোতে ব্যাঘাত ঘটাবে না? যদি আপনারা প্রতিদিন আধ ঘন্টা বা এক ঘণ্টা সময় নির্ধারণ করে নিয়ে আড্ডা দেন, সেটা কিন্তু বেশ সহজ হয়ে যায় উভয়ের জন্য। দিনের চব্বিশ ঘণ্টা সময় থেকে এক-আধ ঘণ্টা সময় বের করা ততটা কঠিন নয়, যতটা কঠিন ছয়-সাত ঘণ্টা সময় বের করা। আর এতে জীবনের স্বাভাবিক কাজগুলোতেও কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে না। জীবনের গতিও মন্থর হলো না, ভালো বন্ধুর সংস্পর্শও থাকলো।
ফেইসবুককে আপনি আপনার পাশের বাড়ির সেই ভালো বন্ধুটার মতোই নিতে পারেন। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আপনি এখানে আসবেন। যাদের লেখাজোকা-আর্টিকেল-ভিডিও দেখা জরুরি মনে হবে সেগুলো পড়ে-দেখে নিয়ে দ্রুত ত্যাগ করবেন এখান থেকে। কোনো ভালো লেখা, ভালো আর্টিকেল, ভালো ভিডিও দেরিতে পড়লে বা দেখলে কোনো সমস্যা নেই। শুরুতে দেখলেও তা যেমন ভালো থাকে, দু-দিন পরে দেখলেও সেটা ভালো-ই থাকবে, পচে যাবে না।
দশ.
ধরা যাক, আপনি দিনে চার ঘণ্টা ফেইসবুক ব্যবহার করেন সব মিলিয়ে। যদি তা-ই হয়, তাহলে একবছরে আপনার ফেইসবুক ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪৬০ ঘণ্টা। বাংলাদেশে একজন মানুষের গড় আয়ু ৬০ বছরের কাছাকাছি। যদি ধরে নেওয়া হয় যে, আপনি ৬০ বছর বাঁচবেন, তাহলে ৬০ বছরে আপনি মোট ৮৭,৬০০ ঘণ্টা ফেইসবুকে কাটান!
তবে জন্মের পর থেকেই তো কেউ ফেইসবুক চালায় না। যদি ধরা হয় যে, পনেরো বছর বয়সে আপনার হাতে স্মার্টফোন এলো এবং পঞ্চাশ বছর বয়স অবধি আপনি ফেইসবুকে সক্রিয় থাকলেন, তাহলে বাকি থাকে পঁয়ত্রিশ বছর। বছরে যদি আপনি ১৪৬০ ঘণ্টা ফেইসবুক চালান, পঁয়ত্রিশ বছরে এই ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫১,১০০ ঘণ্টা!
৮৭৬০ ঘণ্টায় যদি ১ বছর হয়, ৫১,১০০ ঘণ্টা মানে প্রায় ৬ বছরের কাছাকাছি। অর্থাৎ, ৩৫ বছরের স্মার্টফোন ব্যবহারের সময়কালে জীবন থেকে ছয়টা বছর আপনি হারিয়ে ফেলবেন শুধু ফেইসবুক স্ক্রল করতে করতে! ভাবা যায় কী এক ভয়াবহ ব্যাপার এটা?
এটা কেবল যারা দিনে চার ঘণ্টা ফেইসবুক ব্যবহার করে তাদের হিশেব, ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন বহু মানুষকে চিনি, যারা প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ ঘণ্টা ফেইসবুক ব্যবহার করে। আমি এমন লোকও পেয়েছি, যারা দিনে ১৫-১৮ ঘণ্টা ফেইসবুকে কাটায় এবং তা কোনো কারণ ছাড়াই। এদের ক্ষেত্রে হিশেবটা তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
এগারো.
অস্বীকার করবো না যে, প্রযুক্তি আমাদের জীবনটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে, কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার, সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কি আমাদের জীবন থেকে প্রকৃত আনন্দটুকু কেড়ে নিচ্ছে না? শেষ কবে আমরা নিজেদের জন্য একটু সময় বের করেছি মনে পড়ে? শিশিরভেজা ঘাসে একটু হাঁটবার জন্য, বিমুগ্ধ বিস্ময়ে পাখ-পাখালির গান শোনবার জন্য, নদীর কলতান আর সমুদ্রের গর্জনে নিজেকে একাকার করবার জন্য শেষ কবে আমরা সময় করতে পেরেছি?
শারীরিক ক্ষতি তো আছেই, আত্মিক দিক থেকেও সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি কি আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে না? সালাতে দাঁড়ালেই আমাদের কি অনলাইন জগতের নানান কথাবার্তা, নানান ঘটনা মনে পড়ে না? অনলাইনে কী লিখছি, কী পড়ছি, কী দেখছি–তা নিয়ে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থাকতে গিয়ে, আমাদের ঈমান-আমলের যে বেহাল দশা হয়ে আছে, তা ভেবে দেখবার সময় হয়েছে কখনো? টেক-জায়ান্টেরা তাদের ব্যবসার নিমিত্তে এখানে পেতে রেখেছে একটা মোহনীয় খেলাঘর, আর সেই খেলাঘরে আমরা দিব্যি খরচা করে যাচ্ছি আমাদের জীবন।
জীবনটা বড় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এই জীবনের বড় একটা অংশ যদি অযথা, অহেতুক কোনো আসক্তির পেছনে খরচ হয়ে যায়, কতটাই বা তবে বিকশিত হতে পারে মানবজীবন?
——–
[1] সুরা নাবা, আয়াত : ৯-১১
১২. হৃদয়ের জানালাটা খুলে দাও না
এক.
দূর সম্পর্কের এক দরিদ্র আত্মীয়কে আর্থিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু৷ দারিদ্র্যের ভারে নুইয়ে পড়া জীবনের অচলাবস্থায় আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন তার সাহায্যের অন্যতম ভরসাস্থল।
কিন্তু যেবার আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহার ব্যাপারে মদিনার মুনাফিকেরা কুৎসা রটালো, চারিত্রিক কালিমার যে অপবাদ তারা লেপ্টে দিতে চেয়েছিলো উম্মুল মুমিনিনের গায়ে, সেই ঘটনায় যুক্ত হয়ে পড়েছিলো আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর সেই আত্মীয়ও।