নয়.
আমার এক ফেবু-বন্ধু গতবছর আমাকে ম্যাসেজ করে। তিনি মেডিকেলের ছাত্র। ম্যাসেজে তিনি লিখলেন, ‘আসোলামু আলাইকুম ভাই। কয়েকটা কথা শেয়ার করতে চাই আপনার সাথে। আসলে আমি বেশ অগোছালো জীবনযাপন করছি। সময়মতো সালাত, ঘুম, নিজের পড়া, টিউশান বা দৈনন্দিন কাজ–কোনোটাই ঠিকঠাকভাবে করতে পারছি না। এসবের পেছনে মূল যে কারণ, তা হলো মোবাইল আসক্তি। আরো স্পষ্ট করে বললে–ফেইসবুকের নেশা। ফেইসবুকের নেশার কারণে আমার সালাতেও ব্যাঘাত ঘটে। অযথা মাইলের পর মাইল ল করি। এই নেশা থেকে বেরোবার কোনো উপায় থাকলে যদি বলতেন।
তার সাথে কথা বলে জানলাম–ফেইসবুকে তিনি কোনো আজেবাজে গ্রুপ-পেইজ প্রোফাইলের সাথে যুক্ত নন। তিনি যা ফলো করেন, যাদের সাথে যুক্ত আছেন সবই এবং সবাই ইসলামিক। তিনি ইসলামিক বইয়ের গ্রুপে যুক্ত, ইসলাম নিয়ে লেখে এমন মানুষদের ফলো করেন, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে–ফলো লিস্টে ইসলামি পরিবেশ বজায় রেখেও কেন তার জীবন এরকম অগোছালো হয়ে উঠলো? কেন তার নাওয়া-খাওয়া, ঘুম, পড়াশোনা আর কাজের এমন বেহাল দশা? এমনকি–সালাত আদায়েও কেন তাকে পড়তে হচ্ছে সমস্যায়?
এই প্রশ্নটার জবাব খোঁজা জরুরি।
আমরা অনেকেই মনে করি–ফেইসবুকে নাহয় সাত-আট ঘণ্টা পার করছি, কিন্তু তা তো অহেতুক কাটছে না, আজেবাজে লেখা পড়ছি না, জিনিস দেখছি না। ইসলামিক লেখা পড়ছি, ইসলামিক ভিডিও দেখছি। সময়গুলো তো ভালো কাজেই কাটছে। সুতরাং, দিনের লম্বা সময় ফেইসবুকে এভাবে কাটালে তা তো খুব একটা মন্দ নয়।
এমন ভাবনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে হয়–ভাবনাটা আংশিক ভালো, পুরোটা নয়। আপনি হয়তো সারাদিন অনেক ইসলামিক লেখা পড়ছেন, অনেক ইসলামি ক্লিপস দেখছেন, কিন্তু তা যদি আপনার বাস্তব জীবনে প্রয়োগ না করতে পারেন, তাহলে এতগুলো সময় এখানে দেওয়ার ফল কী? ফেইসবুকে বিভোর হয়ে ইসলামিক পোস্ট, ভিডিও দেখার কারণে যদি আপনার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদি আপনি ঠিকমতো আপনার স্বামী-পরিবার-শিশুদের দেখভাল না করতে পারেন, যদি আপনি স্ত্রী-পরিবারকে সময় না দিতে পারেন, যদি আপনার পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদি ভর্তি না হতে পারেন স্বপ্নের বিদ্যাপীঠে, যদি কর্মক্ষেত্রে আপনার পারফরম্যান্স কমে যায়, আপনার চাকরি হুমকির মুখে পড়ে, এমনকি যদি ঠিকঠাক সময়ে সালাত আদায় করতেই আপনি হিমশিম খান–এসবের বিনিময়েও কি কেবল ফেইসবুকে ইসলামিক পোস্ট পড়া, ভিডিও দেখাকে গুরুত্ব দেবেন? ইসলাম মানুষের জীবনে শৃঙ্খলা আনে, কিন্তু আপনি যেভাবে ইসলামকে শিখতে চাচ্ছেন তা কি আদৌ আপনার জীবনে শৃঙ্খলা এনে দিচ্ছে?
এর ফলাফল কী জানেন? একটা সময়ে আপনি আপনার ভুলটা বুঝতে পারবেন। না, ইসলামিক কন্টেন্টের সাথে সংযুক্ত থেকে ভুল করেছেন তা বলছি না, ভুলভাবে এখানে সময় ব্যয়ের ব্যাপারটা একদিন আপনার সামনে স্পষ্ট হবে, তবে অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার পরে। একদিন যখন সম্পর্কগুলো ভেঙে খান খান হয়ে যাবে, কর্মক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা খুঁইয়ে যেদিন আপনি হতাশায় ডুবে যেতে থাকবেন, স্বপ্নের বিদ্যাপীঠে পড়তে না পেরে যেদিন আপনার বুকটা ভীষণ ভারী হয়ে উঠবে, যেদিন যোগ্যতার জন্য ভালো জায়গায় আপনার একটা চাকরি হবে না, একটা ক্যারিয়ার হবে না, সেদিন আপনি বুঝবেন–এসব অনিয়ন্ত্রিত, অপরিকল্পিত ফেইসবুকিং আপনাকে হতাশা ছাড়া জীবনে আর কিছু দেয়নি।
ফেইসবুকে নানান ইসলামিক লেখকদের লেখাজোকা পড়ে, ভালো বক্তাদের লেকচার-ভিডিও দেখে আপনার মনেও হয়তো তাদের মতো হওয়ার সাধ জাগে। তাদের মতো করে লিখবার, বলবার ইচ্ছে হয়তো আপনারও আছে। আপনিও চান তাদের মতো করে দ্বীন প্রচার করতে, দ্বীনের বার্তাসমূহ ছড়িয়ে দিতে। আপনার ইচ্ছেটা অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু ইচ্ছেপূরণের জন্য যে রাস্তায় আপনি হাঁটছেন, তা আদৌ ঠিক না ভুল–তা কখনো জানতে চেয়েছেন? আপনি যাদের মতো হওয়ার জন্য দিন-রাত ফেইসবুকে পড়ে থাকছেন, তাদের কজন আপনার মতো করে ফেইসবুকে পড়ে থেকে নিজেকে গড়তে পেরেছে? যে লেখকের লেখা পড়ে আপনি অভিভূত হোন, তিনি কি আপনার মতো সারাদিনমান ফেইসবুকে পড়ে থেকে এত সুন্দর করে লিখতে শিখেছেন? নাকি, এর পেছনে তাকে ব্যয় করতে হয়েছে অনেক সময়, দিতে হয়েছে অনেক শ্রম? যার লেখায় বাহারি তথ্য আর নতুন ভাবনার দিগন্ত দেখে আপনি বিস্ময়াবিভূত হয়ে পড়েন, তিনি যদি দিন-রাত এক করে ফেইসবুকে কাটাতেন, পারতেন এতসব তথ্য আর ভাবনার নতুন নতুন দুয়ার আপনার সামনে উন্মোচন করতে? নাকি, এসবের জন্য তাকে অনেক পড়তে হয়, অনেক জানতে হয়? সম্ভব কি ফেইসবুকে বুঁদ হয়ে থেকে এতবেশি পড়া আর জানা? যে বক্তার বলার ধরন, জ্ঞানের সীমা-পরিসীমা আপনাকে মুগ্ধ করে রাখে, যার মতো হওয়ার চিন্তা আপনাকে স্বপ্নেও তাড়িয়ে বেড়ায়, ফেইসবুকে বুঁদ হয়ে থাকলে তিনি কি পারতেন তার সেসব যোগ্যতা অর্জন করতে?
আপনি স্বীকার করবেন যেভাচুয়ালে যাদের আপনি অনন্য, অসাধারণ হিশেবে চেনেন এবং যাদের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তারা সবাই একটা পদ্ধতির ভেতর দিয়ে, একটা ধারা বজায় রেখে এসব যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাদের মতো হতে হলে আপনাকেও এগুতে হবে একটা পদ্ধতির ভেতর দিয়ে। এই পদ্ধতির ভেতর দিয়ে এগুতে হলে সবার আগে যা দরকার, তা হলো ফেইসবুকের নেশা ত্যাগ করা। ফেইসবুকে যে অপরিসীম সময় আপনি ব্যয় করছেন তার লাগাম টেনে ধরা।