প্রযুক্তি-বিস্ফোরণের এই যুগে এখন আমরা প্রায় সকলেই ইনসমোনিয়ার রোগী। ইনসমোনিয়ার রোগীদের সাথে আমাদের মৌলিক পার্থক্য হলো এই–তারা ঘুমোনোর চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারে না, আর আমরা ঘুমোনোর চিন্তা বাদ দিয়ে রাতভর সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকি।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের জন্য আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে স্মার্টফোন আছে। বলাই বাহুল্য–এই স্মার্টফোনের স্ক্রিন থেকে বিচ্ছুরিত হয় একধরনের নীল আলো এবং এই নীল আলোই এখন আমাদের জন্য এক নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে।
ব্যাপারটা বোঝার জন্য আপনাকে ঘুমের চক্রটা বুঝতে হবে। ঘুম আমাদের শরীরের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় এবং মানবসভ্যতা টিকে থাকার অন্যতম অনুষঙ্গ। আমাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপে যদি ঘুমের বন্দোবস্ত থাকতো, তাহলে মানবসভ্যতা কোনোদিনও টিকে থাকতে পারতো না। স্নায়ুতন্ত্র আছে এমন কোনো প্রাণীই ঘুমহীন বেঁচে থাকতে পারে না। ঘুম একপ্রকার অক্সিজেন গ্রহণের মতোই জরুরি।
আমাদের মস্তিষ্কে ঘড়ির মতো একটা অনন্য অসাধারণ প্রযুক্তি দিয়ে রেখেছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা। এটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়–’সার্কেডিয়ান রিদম। প্রতিদিনকার চব্বিশ ঘণ্টা সময় অনুসারে মস্তিষ্ক থেকে এই ঘড়ি শরীরের বিভিন্ন অংশে নানান সংকেত পাঠায় এবং শরীর সে মোতাবেক কাজ সম্পাদন করে। আমাদের ঘুমের জন্যও এই ঘড়িটা সংকেত তৈরি করে। মস্তিষ্ক থেকে মেলাটোনিন নামের একপ্রকার হরমোন নিঃসরণ হলেই আমাদের চোখে ঘুমের আবেশ এসে ভর করতে থাকে।
তবে মস্তিষ্ক কখন মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণ করবে তা নির্ভর করে সার্কেডিয়ান রিদম তথা আমাদের মস্তিষ্কে থাকা সেই ঘড়ির সংকেতের ওপরে। সেই ঘড়ির সংকেত পেলেই কেবল মস্তিষ্ক মেলাটোনিন নিঃসরণের কাজ আরম্ভ করে দেয়; কিন্তু সার্কেডিয়ান রিদম বা সেই ঘড়িটা কখন বুঝবে যে এখন মেলাটোনিন নিঃসরণের সময়? ঘড়িটা তা বুঝতে পারে আলোর উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ, সার্কেডিয়ান রিদম যখন দেখে যে, আপনার চারপাশে আলোর উপস্থিতি ক্রমেই কমে আসছে, ফিকে হয়ে আসছে আলোর বিচ্ছুরণ, তখন সে বুঝতে পারে যে–রাত নামছে। রাত যেহেতু নামছে, সারাদিন কর্মব্যস্ততায় থাকা শরীরের অঙ্গগুলোর এখন একটু বিশ্রাম দরকার। আলোর অনুপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সার্কেডিয়ান রিদম মস্তিষ্কে সংকেত প্রেরণ করে–এখন রাত হয়েছে এবং ঘুমের জন্য মেলাটোনিন তৈরি করা দরকার। এই সংকেত পেয়ে মস্তিষ্ক মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণ শুরু করে এবং তা আস্তে আস্তে আমাদের চোখে এনে দেয় ঘুমের আবেশ। একসময় আমরা বিছানায় গা এলিয়ে দিই এবং আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি গভীর নিদ্রায়।
কিন্তু অতীব দুঃখের কথা হলো এই–আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের শরীরে যে প্রাকৃতিক পদ্ধতি দিয়ে রেখেছেন, আধুনিক প্রযুক্তির কারণে তা নানানভাবে ব্যাহত হচ্ছে আজকাল। ঘুমের জন্য আমাদের শরীরে থাকা এই প্রাকৃতিক পদ্ধতি আজ স্মার্টফোনের কবলে পড়ে বিধ্বস্ত-প্রায়।
স্মার্টফোন ব্যবহারের মাত্রা এবং তাতে নিবিড়ভাবে বুঁদ হয়ে থাকার পরিমাণ রাত হলেই বাড়ে৷ রাতে যেহেতু আমাদের হাতে কোনো কাজ থাকে না, তাই রাতের সময়টাতে আমরা ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ও ইউটিউবে বিচরণ করি বেশি। বিছানায় শুয়ে একেবারে চোখের অতি-নিকটে স্মার্টফোন ধরে রাখাটা এখন আমাদের নিত্যকার অভ্যাস। এতে করে কী হয় জানেন? স্মার্টফোন থেকে বিচ্ছুরিত হওয়া নীল আলোর কারণে আমাদের মস্তিষ্কের সেই ঘড়ি তথা সার্কেডিয়ান রিদম বিভ্রান্ত হয়। এই নীল আলোর কারণে সে বুঝতে পারে না যে–এখন কি রাত না দিন। তার হিশেব মতে তখন রাত-ই হওয়ার কথা, কিন্তু বিচ্ছুরিত নীল আলো। তাকে মস্তিষ্কে মেলাটোনিন নিঃসরণের সংকেত প্রদানে বাঁধা দেয়। সে ধরে নেয়। এখনো রাত নামেনি, দিন-ই আছে। সুতরাং, মস্তিষ্কে মেলাটোনিন নিঃসরণের সংকেত পাঠানোর বদলে সে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধির সংকেত দেয়, কোষে শক্তি বাড়ানোর সংকেতসহ সে এমন সংকেত মস্তিষ্কে প্রেরণ করতে থাকে, যা সে মূলত দিনের বেলা দিয়ে থাকে। ফলে, সার্কেডিয়ান রিদমের এমন সংকেত পেয়ে। আমাদের মস্তিষ্ক দিনের মতোই সক্রিয় হতে শুরু করে দেয়। দিনের বেলায় যেহেতু আমরা শারীরিক আর মানসিকভাবে কাজে লিপ্ত থাকি, তাই দিনে মস্তিষ্কের এমন সংকেত খুব স্বাভাবিক ও উপকারী, কিন্তু রাতে যেহেতু আমাদের কোনো কাজ করতে হয় না সাধারণত, তাই রাতে মস্তিষ্কের এমন সংকেত আমাদের জন্য সবিশেষ উপকারী নয়; বরং রাতে আমাদের জন্য যা দরকারি–একটা নিবিড় ঘুম–সেটাকেই এই নীল আলো ব্যাহত করে রাখে। মস্তিষ্ক যখন মেলাটোনিন নিঃসরণের সংকেত পায় না, তখন আমাদের চোখেও আর ঘুম নামে না।
সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করতে করতে যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি, তখন রাত প্রায় শেষ হয় হয় অবস্থা। মোবাইল ছেড়ে তখন আমরা ঘুমানোর চেষ্টা করি আর সার্কেডিয়ান রিদমকেও সুযোগ করে দিই মেলাটোনিন নিঃসরণের সংকেত তৈরির। তবে এই অভ্যাস আস্তে আস্তে আমাদের শরীরের ও জীবনের ওপর ফেলতে শুরু করে বিরূপ প্রভাব।
আপনি হয়তো বলতে পারেন, রাতে কম ঘুমালেও কী হবে, দিনের বেলা পর্যাপ্ত ঘুমিয়ে কেউ তা পুষিয়ে দিলেই হয়, কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ সত্য নয়। রাতটা মূলত ঘুমের জন্যই নির্দিষ্ট করা। দিনের বেলা প্রকৃতির বিস্ফোরিত আলো, পাখ-পাখালির গুঞ্জন, চারপাশে মানুষের হই-হুঁল্লোড়, গাড়ির হর্ন ইত্যাদি আপনাকে ঠিক সেভাবে ঘুমোতে দেবে না, যেভাবে ঘুমোনোর সুযোগ আপনি রাতের বেলা পেয়ে থাকেন। রাতের বেলা প্রকৃতিজুড়ে এক স্নিগ্ধ আবেশ বিরাজ করে, যা ঘুমের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। রাতে যেহেতু চারপাশের আলো অনেকখানি নিভে আসে, মানুষেরাও ঘুমিয়ে পড়ে এবং পশু-পাখি আর পাখ-পাখালিও ঘুমিয়ে থাকে, তখন ঘুমের জন্য তৈরি হয় এক অসাধারণ পরিবেশ। এমন শান্ত পরিবেশে আপনার যে ঘুম হবে, তার সাথে দিনের কোলাহল আর ঝাটময় পরিবেশে ঘুমের কোনো তুলনাই হয় না।