খেয়াল করলে দেখবেন–সোশ্যাল মিডিয়ায় মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত কাউকে যখন খেতে ডাকা হয়, অধিকাংশ সময়েই হয় সে নিরুত্তর থাকে অথবা বেশ বিরক্তিভরে সে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। শুধু খাওয়ার বেলাতেই নয়, সোশ্যাল নেটওয়ার্কের বাইরের কোনো কাজে সে আর উৎসাহ পায় না। তার মন চায়–কত দ্রুত কাজ শেষ করে স্মার্টফোন হাতে নেওয়া যাবে আর ডুব দেওয়া যাবে নীল-শাদার জগতে।
সোশ্যাল মিডিয়া আরো একভাবে হতাশা আর মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে মানুষের মনে। গবেষকরা সেটাকে বলছেন FOMO (Fear Of Missing Out). অর্থাৎ, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত একজন ব্যবহারকারীর মনে সর্বদা এই ভয় কাজ করে যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটু অনুপস্থিত থাকলে দুনিয়ার কী না কী সে বুঝি মিস করে ফেলে!
দুনিয়ার কোথায় কী ঘটলো, কার কী হলো, কে কী করলো–এসবকিছুর সাথেই সে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে চায়। কোনো সংবাদ, কোনো ঘটনা, কোনো ইস্যু সে মিস করে যেতে চায় না। এই ‘চাওয়া প্রবণতাই তাকে টেনে ধরে রাখে নীল-শাদার দুনিয়ায়। যদি কোনোভাবে সে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসতে না পারে কিংবা কোনো কারণে যদি তার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ডাউন হয়ে যায়, এক ভীষণ মানসিক অস্থিরতা তখন তাকে পেয়ে বসে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আসতে না পারার ফলে তার মনে হয়, সে বুঝি দুনিয়া থেকেই ছিটকে পড়েছে। ঘটনার স্রোত থেকে ছিটকে পড়ার এই ভয়টাকেই গবেষকরা Fear Of Missing Out বলে অভিহিত করছেন।
চার.
আমার একবার জানতে ইচ্ছে হলো–এই যে সোশ্যাল মিডিয়াকে ঘিরে আমাদের এই নেশা, এই উন্মত্ত উন্মাদনা, দিন-রাত এক করে এখানে পুঁদ হয়ে থাকা, আমাদের অবস্থাই যদি এমন হয়, এসব মিডিয়া যাদের হাতে গড়া, তাদের অবস্থা জানি কী হবে! এমন কৌতূহল থেকেই আমি টেক-জায়ান্টদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে এসবের ভূমিকা নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলাম। ফলাফল হিশেবে যা পেলাম, তাতে আমি একেবারে থ!
প্রযুক্তি-দুনিয়ায় যাকে প্রথম সারির একজন ধরা হয়, সেই অ্যাপল ব্রান্ডের সিইও স্টিভ জবসের বরাতে জানা যায়, তার শিশুরা আইপ্যাড ব্যবহারের ক্ষেত্রে কখনোই স্বাধীন ছিলো না। অর্থাৎ, ইচ্ছে হলেই শিশুরা আইপ্যাড নিয়ে বসে যেতে পারতো না বা সারাদিনমান আইপ্যাডে বুঁদ হয়ে থাকতে পারতো না। প্রতিদিন কত সময় তারা আইপ্যাড ব্যবহার করতে পারবে, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া ছিলো। এমনকি, রাতে খাওয়ার টেবিলে কোনো প্রকার ডিভাইস যাতে পরিবারের কারো হাতে না থাকে, সেদিকে থাকতো স্টিভ জবসের সজাগ দৃষ্টি। ওই সময়টায় এই টেক-বস শিশু এবং পরিবারের সবার সাথে মুখোমুখি কথা বলতে পছন্দ করতেন। আলাপ। করতেন বিভিন্ন বই নিয়ে, বিজ্ঞান নিয়ে, ইতিহাস নিয়ে।
গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই-ও জানাচ্ছেন একই কথা। তার ঘরে শিশুদের জন্য ডিভাইস ও টেলিভিশন উন্মুক্ত নয়। কোনো রাখঢাক না রেখেই এই টেক-জায়ান্ট জানাচ্ছেন–এই কাজ তিনি তার শিশুদের ভালোর জন্যই করে থাকেন।
অ্যাপলের স্টিভ জবস বা গুগলের সুন্দর পিচাই কেবল নয়, মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের ব্যাপারেও একই কথা। তার শিশুদের জন্যও স্ক্রিন-টাইম ছিলো যথেষ্টই সীমিত। ইউটিউবের সিইও এবং রেড্ডিটের প্রতিষ্ঠাতারাও তাদের শিশুদের স্ক্রিন-টাইম নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক। স্ন্যাপচ্যাটের প্রতিষ্ঠাতা ইভান স্পাইগেল তো তার শৈশব-কৈশোরে মোবাইল ফোন-ই হাতে পাননি এবং তার আজকের সফলতার পেছনে ছোটোবেলার ডিভাইস-ফ্রি লাইফের যথেষ্ট ভূমিকা আছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি নির্ধারণ করেছেন–তার শিশু সপ্তাহে সব মিলিয়ে কেবল দেড় ঘণ্টা স্মার্ট-ডিভাইস ব্যবহারের সুযোগ পাবে।
আমি আশ্চর্য বনে যাই–যেসব মানুষ তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দিয়ে দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষকে স্ক্রিনে বুঁদ করে রাখছে, তারা কেন নিজেদের এবং তাদের শিশুদের স্ক্রিন-টাইম নিয়ে এতখানি সতর্ক? এর পেছনের রহস্যটা কী? স্ক্রিনের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়ে যারা ভাবছি যে, অনেক কিছুই আমরা শিখে ফেলছি, আমাদের মতো করে কেন ভাবতে পারেন না এসব স্ক্রিন কারিগরেরা?
কেন স্টিভ জবস তার শিশুকে আইপ্যাডের সামনে অবাধে ছেড়ে দিতে রাজি হন না? কেন ইউটিউবের সিইও তার শিশুদের ইউটিউবের সামনে বুঁদ হয়ে থাকতে বলেন না? কেন গুগলের সিইও তার শিশুদের ডুবে যেতে দেন না গুগলের সীমানাহীন তথ্য ভান্ডারে?
সচেতন পাঠক, এর একটাই কারণ–এখানে আপনি যতখানি না শেখার জন্য সময় ব্যয় করেন, তারচে বেশি সময় ব্যয় করেন আসক্তির কারণে। এসব সোশ্যাল মিডিয়ার এলগরিদম এমনভাবেই সাজানো, যাতে আপনি অনেক বেশি সময় এখানে কাটাতে বাধ্য হন। আপনি বাঁধা আছেন এক অদৃশ্য শেকলে। শেকলে বন্দিবস্থাকে দুনিয়ার কেউ ভালোবাসে না, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া যে শেকল আপনার পায়ে পরায়, তা অন্যসব শেকলের চাইতে আলাদা। এই শেকলকে আপনি নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেন। তাই তো সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকতে না পারলে আপনি অস্থির হয়ে যান। আপনি ভাবেন–আপনার দুনিয়া বুঝি থমকে গেলো!
পাঁচ.
এটা সত্য যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি থাকলেও আমরা যে আদৌ আসক্ত, তা বুঝতে বা শনাক্ত করতে আমরা অধিকাংশই ব্যর্থ হই। এই আসক্তিটা আমাদের জীবনে এতখানি স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়–সেটাকে কখনো সন্দেহের চোখে দেখার কিংবা সেটা নিয়ে একটু উদ্বিগ্ন হওয়ার চিন্তা আমাদের মাথায় কখনোই আসে না। সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তিটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের রুটিন আর স্বাভাবিক অনেক রুটিন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন থেকে।