আমি বলছি না যে, এই গুণগুলো খারাপ কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় এসবের বিকাশ যথেষ্ট সমস্যার; তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ধারাবাহিক পরিচিতি আস্তে আস্তে তার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং একসময় এই পরিচিতিকে টেনে নিয়ে যেতে তাকে রাত-দিন এখানে বুঁদ হয়ে থাকতে হয়।
ধরা যাক, তিনি ফেইসবুকে একটা নাতিদীর্ঘ লেখা লিখলেন এবং তাতে তিনি যথেষ্ট পরিমাণে মন্তব্য পেলেন। সাথে পেলেন অনেকগুলো লাইক। এ ধরনের আরো কন্টেন্ট তৈরিতে এই অর্জন তাকে অবশ্যই প্রলুব্ধ করবে এবং তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করবেন যে–তার কথা এবং চিন্তা মূল্য পেতে শুরু করেছে। যেহেতু তিনি অন্যদের নজর কাড়তে পারছেন, তাই এই বিশেষ নজরটাকে আরো বাড়াতে বা অন্তত ধরে রাখতে তিনি সচেষ্ট হয়ে ওঠেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের নজর কাড়তে বা আলোচনায় থাকতে তার এই যে পরবর্তী প্রবণতা, বিজ্ঞান জানাচ্ছে, এটা হয় মস্তিষ্ক থেকে এক ধরনের হরমোন নিঃসরণের কারণে। পাঁচটা লাইককে দশটা করবার জন্য, দুটো মন্তব্যকে চারটে করার জন্য, ব্যাপক প্রশংসিত হবার জন্য তখন তার ভেতরে একটা প্রবণতা কাজ করে। এই প্রবণতাকে অনেকসময় সরাসরি বোঝা যায় না। মনে করা হয়–আমি তো নতুন কিছু শিখছি, নতুন কিছু শেখাচ্ছি, নতুন কিছু জানছি। নতুন কিছু শেখা, শেখানো আর জানার ভেল্কিতে প্রলুব্ধ হয়ে তাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটাতে হয়। ঘন্টার পর ঘণ্টা। স্ক্রল করতে হয় মাইলের পর মাইল, কিন্তু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে–সোশ্যাল মিডিয়া ক্রল করে পুরোদিনে একজন ব্যক্তি যা-কিছু শেখে, তা খুবই সামান্য এবং ওই সামান্য জ্ঞানটার প্রভাবও তার জীবনে খুবই ক্ষণস্থায়ী।
এটা কেন হয় সেটাও আমি ব্যাখ্যা করছি।
ধরা যাক, একজন ব্যক্তি ফেইসবুকে দশজন লোককে ফলো করেন। যে দশজনকে তিনি ফলো করেন, সেই দশজন যে একই সময়ে এবং একই বিষয়ে লিখবে–তা কিন্তু বলা যায় না। এমনটা সম্ভবত কদাচিৎও ঘটে না। কারণ ব্যক্তি বিশেষের আগ্রহ অবশ্যই আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। দেখা যায়, ওই দশজনের কেউ কুরআন হাদিসের কথা লেখে, কেউ লেখে রাজনীতি-সমাজনীতি নিয়ে। কারো লেখাজোকা হয় খেলাধুলাকেন্দ্রিক। কেউ চর্চা করে দর্শন আর কেউ হয়তো-বা আগ্রহ পায় বিজ্ঞানে বা সাহিত্যে। ওই লোক যখন ফেইসবুক স্ক্রল করে, তখন তার নিউজফিডে এই ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের, ভিন্ন ভিন্ন ভাবনার লেখাজোকা এসে হাজির হয়। কুরআন হাদিসের লেখাটা পড়ার পরে তার সামনে আসে দর্শনের আলাপ। দর্শনের আলাপ শেষ হলে আসে রাজনীতির মারপ্যাঁচ। রাজনীতি পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর সামনে এসে হাজির হয় বিজ্ঞানের তত্ত্বকথা। বিজ্ঞান বিদেয় নিলে আসে সাহিত্য আর সাহিত্যের পাঠ চুকা মাত্রই সেখানে খেলাধুলা ঢুকে পড়ে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো বিষয় যখন সামনে চলে আসে, তখন কোনো আলোচনার সারবস্তুই যে আসলে মাথায় ঢুকবে না–সেটাই স্বাভাবিক। একসাথে এতগুলো বিষয় পড়তে গিয়ে কোনো বিষয়ই ভালোভাবে পড়া হয় না। পড়লেও তা হয় নেহাতই চোখ বোলানো। এটা তো দশজন ব্যক্তিকে ফলো করলে যা অবস্থা হবে, তার হিশেব; বস্তুত সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা শয়ে শয়ে মানুষকে ফলো করি। আমাদের নিউজফিড নানান তথ্য, নানান বিষয় আর হরেক রকমের আলোচনায় যে ভর্তি থাকে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এতসব মানুষের এত এত লেখাজোকা, এত এত আলোচনা পড়তে গিয়ে আমরা নিজেদের অজান্তেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে তখন মস্তিস্কে আলাদা জায়গা দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। সকালবেলা যে ভালো ব্লগটা পড়া হয় বা যে ভিডিও দেখে কোনো একটা কিছু শেখবার তাড়না কাজ করে মনে, টানা নিউজফিড ফ্রল। করার পর সেই ভালো ব্লগটার বিষয়বস্তুই মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে যায় অথবা নষ্ট হয়ে যায় ভিডিও দেখে পাওয়া স্পৃহাটুকুও।
মাত্রাতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার দিনশেষে আমাদের যা দুহাত ভরে দেয় তা হলো–একরাশ ক্লান্তি। মাইলের পর মাইল হাঁটলে আমরা যেমন শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, মাইলের পর মাইল নিউজফিড স্ক্রল করার পর আমাদের মস্তিষ্কও সেরকম ক্লান্ত হয়ে পড়ে আর এই ক্লান্তি ধীরে ধীরে রূপ নেয় একটা মানসিক সমস্যায়।
আপনি হয়তো ভাবছেন–মাত্রাতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার থেকে কীভাবে মানসিক সমস্যা তৈরি হয়, তাই তো? এটা নিয়েও বিস্তর গবেষণা হয়েছে।
ওপরে আমরা ‘সোশ্যাল প্রোফাইল’ তৈরি এবং তা কীভাবে একজন মানুষকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ করে রাখে, তা সম্পর্কে বলেছি। এই সোশ্যাল প্রোফাইলকে টেনে নিয়ে যেতে, সেটাকে দিনের পর দিন আরো ভারী, আরো পোক্ত করে তুলতে এক অনিঃশেষ তাড়না কাজ করে মনে; কিন্তু কোনোভাবে যদি সেই সোশ্যাল প্রোফাইল তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটে বা ঠিক যে লক্ষ্যমাত্রায় নিজেকে কল্পনা করা হয়, তা যদি অর্জন না করা যায়, তখন একটা মানসিক চাপ অনুভূত হয়। নিজেকে মনে হয় পরাজিত। মানুষ তখন নিজেকেই সন্দেহ করতে শুরু করে। ভাবে তার সৃজনশীলতার বুঝি অবনতি হচ্ছে। তাকে সম্ভবত মানুষজন আর পছন্দ করছে না। তার কন্টেন্ট দিয়ে সে বুঝি আর লোকজনকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। এ ধরনের এক হতাশাবোধ তাকে তখন তাড়িয়ে বেড়ায় এবং সেটা শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় এক ভয়ংকর মানসিক বৈকল্যে। মানসিক অবস্থার এই পর্যায়ে চারপাশের সবাইকে এবং সবকিছুকে তার বিরক্ত লাগে।