তবে আপনি যদি ফিরে আসেন, যদি যাবতীয় ভুলের জন্য করজোড়ে আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করেন, যদি অনুতপ্ত হোন, অনুশোচনায় যদি আপনি নত হতে পারেন, তিনি বলছেন–তাঁর আযাব তিনি আপনার ওপর আরোপিত করবেন না।
জীবনের বদ্ধ দুয়ারগুলো খোলার জন্য আপনার হাতে একটা চাবি আছে। সেই চাবির নাম ইস্তিগফার। চাবিটা ব্যবহার করে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আজ থেকেই তৎপর হয়ে পড়ুন। ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ শব্দটাকে বানিয়ে নিন জীবনের নিত্য সঙ্গী।
————
[1] সুরা নুহ, আয়াত : ১০-১২ [২] আল-জামি লি আহকামিল কুরআন (তাফসিরুল কুরতুবি), ইমাম কুরতুবি, খণ্ড : ১৮; পৃষ্ঠা : ৩০২
[3] সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড : ১১; পৃষ্ঠা : ৩২১-৩২২; মানাকিবুল ইমাম আহমাদ, পৃষ্ঠা : ৫১২
[4] তাফসিরুল কুরতুবি, খণ্ড :১৮; পৃষ্ঠা : ৩০২; জামিউল আহাদিস: ২৯৮৮৪; আল-লুবাব ফি উলুমিল কিতাব, খণ্ড : ১৯; পৃষ্ঠা : ৩৮৫
[5] সুরা আনফাল, আয়াত : ৩৩
১১. খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে
এক.
আমেরিকার টাইম স্কয়ারের নাম আমরা প্রায় সবাই শুনে থাকবে। পৃথিবীর সবচাইতে ব্যস্ত এলাকার তালিকায় সম্ভবত টাইম স্কয়ার তার ঐতিহ্য আর আভিজাত্য নিয়ে সবার শীর্ষে অবস্থান করে আছে। রিপোর্ট অনুসারে প্রতিবছর ৫০ মিলিয়ন মানুষ টাইম স্কয়ার পরিদর্শনে যায়!
তবে আমার ধারণা, ভাচুয়াল পৃথিবীকেও যদি আমরা আমাদের পৃথিবী ধারণার আওতাভুক্ত করি, টাইম স্কয়ারের এই বিশাল রেকর্ড নিমিষেই হাওয়া হয়ে যাবে! টাইম স্কয়ারের কিনারে বছরে ৫০ মিলিয়ন মানুষের পদচিহ্ন পড়ে কেবল, আর গ্লোবাল জরিপের মতে–সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা একদিনেই বাড়ে ১.৪ মিলিয়ন করে! প্রতি সেকেন্ডে নতুন করে ১৬ জন ব্যবহারকারী প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে! সোশ্যাল মিডিয়ার এই রেকর্ডের সামনে টাইম স্কয়ারের রেকর্ড তো একমুহূর্তও দাঁড়াতে পারবে না।
দুই.
প্রযুক্তি বদলে দিয়েছে দুনিয়ার মোড়। এখন আমরা ঘরে বসেই আমেরিকার নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করি, নাসার রকেট ছোঁড়ার দৃশ্য অবলোকন করি আর বন্ধুত্ব করি সুদূর সাইবেরিয়ার কোনো এক অপরিচিত মানুষের সাথে। প্রিয়জনের কাছে আমাদের যে চিঠি পৌঁছাতে আগে লেগে যেতো মাসের পর মাস, এখন আমাদের সেই বার্তা পৌঁছে যায় একটা ক্লিকেই। সময় লাগে কয়েক ন্যানো সেকেন্ড। এক অর্থে জীবন এখানে বড্ড সহজ!
কিন্তু জীবন কি সত্যিই সহজ হলো?
মুঠোফোনে আমেরিকার নির্বাচন আমরা তদারকি করছি ঠিকই, কিন্তু আমাদের ঘরের পাশে যে মানুষটা জীবনসংগ্রামে পরাজিত হতে চললো, তার জীবনটাকে কাছ থেকে দেখবার ফুরসত আমাদের হাতে কই?
নাসার রকেট ছোঁড়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে হাত তালি দিয়ে আমরা বলছি, ‘মানব সভ্যতা আরো একধাপ এগিয়ে গেলো!
মানবসভ্যতা এগুলো ঠিকই, কিন্তু দারিদ্রের ভারে নুইয়ে পড়া আমাদের সমাজটা, যে সমাজ না আগালে আমরা আগাতে পারি না, তা নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা কোথায়?
প্রযুক্তি দুনিয়াকে পুরে দিয়েছে আমাদের হাতের মুঠোয়। তবে একইসাথে, প্রযুক্তি আমাদের বন্দি করেছে মুঠোফোনের শেকলে। এখন আমাদের যাবতীয় আনন্দ বেদনা, সুখ-দুঃখ, চিত্ত-বিনোদনের উৎস হয়ে উঠেছে স্মার্টফোন। ছবিতে, স্টোরিতে, স্ট্যাটাস-টুইটে দুনিয়াকে প্রতিনিয়ত অবহিত করছি আমাদের দৈনন্দিন হালচাল। প্রাইভেসির দুনিয়ায় এখন আমাদের সমস্তকিছুই যেন ওপেন-সিক্রেট!
তিন.
আমেরিকার বিখ্যাত পত্রিকা সিএনএন ‘Being Thirteen’ শিরোনামে একটা ক্যাম্পেইন চালিয়েছিলো। তেরো বছর বয়সীদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রবণতা কেমন, তা খতিয়ে দেখাই ছিলো ক্যাম্পেইনটার মূল উদ্দেশ্য। বলাই বাহুল্য–জরিপে উঠে আসা ফলাফল ছিলো রীতিমতো চমকপ্রদ ও ভয়ংকর! সেই ক্যাম্পেইনে তেরো বছরের এক কিশোরীকে জিগ্যেশ করা হয়, যদি তার হাতে থাকা স্মার্টফোনটা নিয়ে নেওয়া হয়, তার তখন কেমন অনুভূত হবে?
জবাবে ওই কিশোরী বললো, ‘প্রয়োজনে আমি টানা একসপ্তাহ খাবার খাবো না, কিন্তু স্মার্টফোন হাতছাড়া করতে আমি মোটেও রাজি নই।’
অন্য আরেকজন বললো, আমার হাতে যখন ফোন থাকে না, তখন আমার কাছে। সবকিছু খালি খালি লাগে। কোথায় যেন বিরাট এক শূন্যতা কাজ করে তখন।
স্মার্টফোন কিশোর-মনের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে, তা চিন্তা করলে রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়। একজন কিশোরী টানা একসপ্তাহ কিছু না খেয়ে থাকবে, তবু স্মার্টফোন হাতছাড়া করতে সে একদম-ই রাজি নয়। এই প্রবণতাকে যদি আপনি ‘নেশা’ না বলেন, তাহলে নেশা বলতে ঠিক কী বোঝায় আমার জানা নেই।
আমার ধারণা, কেবল কিশোর শ্রেণি নয়, স্মার্টফোনের এই নেশা এখন মধ্যবয়স্ক, বয়স্কসহ আমাদের প্রায় সবার-ই। এই যে স্মার্টফোন-বিহীন দুনিয়াটাকে খালি খালি লাগে, আমাদের এই প্রবণতার পেছনে মূল কারণটা আসলে কী?
এক কথায় বললে–সোশ্যাল প্রোফাইল!
অনলাইন দুনিয়ায় অজান্তেই আমরা নিজেদের জন্য তৈরি করি একটা সোশ্যাল প্রোফাইল। সেই প্রোফাইল আমাদের টেনে ধরে রাখে ভার্চুয়াল জগতে। ধীরে ধীরে সেই প্রোফাইল ভারী হয় এবং আমরাও তাতে পুরোদস্তুর মজে যাই।
এই সোশ্যাল প্রোফাইল কীভাবে তৈরি হয়, তা জানার জন্য আমরা একজন মানুষের ভার্চুয়াল অ্যাক্টিভিটি কল্পনা করতে পারি। ভার্চুয়াল জগতে, তা হতে পারে ফেইসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, স্নাপচ্যাট, টিকটক বা লাইকি–তিনি যেদিন প্রথম অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন, সেদিনের তুলনায় তার আজকের অবস্থান পুরোপুরি ভিন্ন। সময়ের প্রেক্ষিতে তিনি এখানে ফলো করছেন অনেক প্রোফাইলকে এবং অনেক প্রোফাইল ফলো করছে তাকে। তার একটা পরিচয়ও এখানে দাঁড়িয়ে গেছে। এখানে তিনি হতে পারেন একজন ভালো লেখক, ভালো কবি, গায়ক অথবা ভালো বই পড়ুয়া, ভালো ভ্রমণ-পিয়াসু, ভালো রন্ধনশিল্পী, ভালো ফটোগ্রাফার, ভালো গ্রাফিক্স ডিজাইনার ইত্যাদি। এমনকি অন্যের লেখাতে জুতসই, শিক্ষণীয় মন্তব্য করার কারণেও আস্তে আস্তে একটা সোশ্যাল পরিচিতির তকমা তিনি পেয়ে যান। তার মন্তব্য দেখলেই আমরা বুঝতে পারি যে–তার ভাবনা, চিন্তা এবং বুঝবার ক্ষমতা বেশ প্রখর।