ওয়ামা তাওফিক্বী ইল্লা বিল্লাহ।
আরিফ আজাদ
.
সুচিপত্র
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
যে সুতোয় বাঁধা জীবন
গাহি নতুনের গান
পতনের আওয়াজ পাওয়া যায়
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর
কখনো ভুল হলে
বন্দিশিবির থেকে
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
যে যাই বলুক পিছে
খুলে যাক জীবনের বন্ধ দুয়ার
খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে
হৃদয়ের জানালাটা খুলে দাও না
জীবনের কম্পাস
ভালোবাসা ভালোবাসি
সমুদ্রের সাধ
এবার ভিন্ন কিছু হোক
.
০১. আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
এক.
যাপিত জীবনের গল্প থেকেই বলি–আমরা যখন রোগে-শোকে ভুগি, যখন শরীরে আমরা অনুভব করি কোনো রোগের উপস্থিতি, তখন আমরা ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার, যিনি আমাদের সামনের চেয়ারে উপবিষ্ট থাকেন মাথাভরতি ডাক্তারি-বিদ্যা নিয়ে, তার কাছে আমরা খুলে বলি আমাদের অসুবিধের আদ্যোপান্ত। তিনি বোঝার চেষ্টা করেন আমাদের অসুস্থতা। প্রয়োজনে যন্ত্রপাতি দিয়ে আমাদের শরীর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেন। রোগ নির্ণয়ের পর আমাদের ওষুধ ও জীবনযাত্রার একটা ছক নির্ধারণ করে দিয়ে তা যথাযথভাবে অনুসরণ করার কঠোর হুঁশিয়ারিও প্রদান করেন।
পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে কিংবা আশানুরূপ ফলাফল না এলে আমরা ছুটে যাই শিক্ষকদের কাছে। তাদের কাছে–যারা আমাদের চোখে অধিকতর যোগ্য। কৃতকার্যতার অথবা ভালো ফলাফলের পথ বাতলে দিতে যারা সবিশেষ পারদর্শী, তাদের দুয়ারে ধরনা দিই আমরা। ভালো ফলাফলের রাস্তা বাতলে দিয়ে তারা ধন্য করেন আমাদের। কৃতকার্য হতে হলে যে পথ ধরে এগুতে হবে, যে কঠোর-কঠিন সাধনায় লেগে থাকতে হবে মুখ বুজে–সেই পথ তারা আমাদের চিনিয়ে দেন। মাঝে মাঝে জীবন যখন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, যখন ফিকে হয়ে আসে জীবনের সমস্ত রং, তখন আমরা এমন কাউকে খুঁজি, যে আমাদের একটু আশার আলো দেখাবে। এমন কাউকে–যার কাছে গেলে আমরা খুঁজে পাবো জীবনের ছন্দ, যার স্পর্শ পেলে হয়তো দপ করে জ্বলে উঠবে নিভুনিভু হওয়া জীবন-প্রদীপ।
যাপিত জীবনের শূন্যতাগুলোকে উত্তম বিকল্প দিয়ে প্রতিস্থাপনের বেলায় আমাদের থাকে আপ্রাণ প্রচেষ্টা। যখনই কোনো শূন্যতার বলয়ে আমরা ঘুরপাক খাই, আমাদের অবচেতন মন তার নিজের মতো করে সেই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করে। বস্তুত মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যই এটা। মানুষ শূন্যস্থান পছন্দ করে না বলেই তা পূরণে সে সবিশেষ তৎপর হয়ে ওঠে।
দুই.
রোগ হলে আমরা ডাক্তারের কাছে ছুটি, পরীক্ষায় ভালো ফল লাভের উপায় জানতে ধরনা দিই যোগ্য শিক্ষকের কাছে। বিষিয়ে ওঠা জীবনের যাতনা থেকে মুক্তি পেতে আমরা পাগলের মতন খুঁজে নিই পছন্দের ব্যক্তি, বস্তু অথবা মাধ্যম, যা-কিছু আঁকড়ে ধরলে আমরা বেঁচে থাকার প্রেরণা পেতে পারি; তবে যদি প্রশ্ন করি– নফসের তাড়না থেকে বাঁচতে কখনো কি আমাদের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে? যে কুপ্রবৃত্তির বলয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে সেঁটে আছে জীবন, সেই বলয় ভাঙতে কখনো কি হৃদয়ে দানা বেঁধেছে একটুখানি সাহস?
শরীরে রোগ বাসা বাঁধলে তাকে আমরা সমস্যা বলছি। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়াকে ডাকছি অপ্রাপ্তি বলে। জীবনের ছন্দপতনের নাম দিয়েছি হতাশা; কিন্তু কুপ্রবৃত্তির যে জালে আমি সারাটাজীবন ধরে আটকা পড়ে আছি, তার জন্য কোনো নাম কিংবা কোনো অভিধা কখনো কি ভেবেছি একবারও?
যে তাড়না আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে আল্লাহর নৈকট্য থেকে, যে ধোঁকা আমাকে আত্মমগ্ন করে রেখেছে অবাধ্যতায়, যে আত্মপ্রবঞনায় কেটে যাচ্ছে জীবনের সোনালি সময়, সেই ঘনঘোর অন্ধকার থেকে পালাতে কখনো কি আমার মন চেয়েছে?
কেন আমি বারবার বন্দি হয়ে যাই নফসের শেকলে? কেন কুপ্রবৃত্তির মায়াজাল ভেদ করা আমার জন্য দুরুহ হয়ে ওঠে? কেন বৃত্তের একই কেন্দ্রে আমার নিত্য ভুলের বিচরণ? যে উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় আমার আগমন, সেই উদ্দেশ্য থেকে কেন আমি ভীষণরকম বিচ্যুত? রুহের জগতে মহামহিম আল্লাহ যখন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আমিই কি তোমার রব নই?’, তখন আমি মহোৎসাহে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে, বিস্ময়মাখানো কণ্ঠে বলেছিলাম, ‘অবশ্যই, আপনিই আমার রব।’[1] তবে আজ কেন ভুলে গেলাম আমার জীবনের সেই প্রথম আর পরম স্বীকৃতির কথা?
এই যে কুপ্রবৃত্তির বাঁধনে আমি বন্দি হয়ে আছি, সেই শৃঙ্খল ভাঙার উপায় কী? কোন উপায়ে আমি নিজেকে মুক্ত করতে পারবো এই চোরাফাঁদ থেকে? কোন পথে নিহিত আমার মুক্তি? কীভাবে আমি জীবনের সেই আসল উদ্দেশ্যের বাঁকে ফিরতে পারবো–এসব নিয়ে যদি একটু ভাববার ফুরসত পাই, আমার জন্য সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসবে মহাগ্রন্থ আল কুরআন। যখনই আমি সমস্যার বৃত্তে ঘুরপাক খাবো, তখন যদি নিবিষ্ট মনে আমি খেয়াল করি আল্লাহর কালাম–এই আয়াতের দিকে, আমি পেয়ে যেতে পারি আমার কাঙ্ক্ষিত সেই সমাধান। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া। তাআলা বলছেন–
তাদের পরে এলো এমন এক অসৎ জাতি, যারা সালাত বিনষ্ট করলো এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণকরলো(2)
আমি যদি বুদ্ধিমান হই এবং আমার বিবেচনাবোধ আর উপলব্ধি ক্ষমতা যদি একেবারে ফুরিয়ে না গিয়ে থাকে, তাহলে এতক্ষণে আমি বুঝে গেছি, আমার শূন্যতাটা আসলে কোথায়। কোন জায়গায় এসে আমার জীবন থমকে গেছে, কোন কেন্দ্রে এসে আমি আসলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি, কোন ভ্রান্তির মায়াজালে আমি আটকে পড়েছি তা এতক্ষণে আমার চোখে পড়ার কথা।