নবিজির মৃত্যুর দিন সবাই যখন শোকাহত, বিষণ্ণতার ভীষণ ভারে যখন নুইয়ে আছে উম্মাহর তনু-মন, সেদিন ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু ভাবলেন একেবারে ভিন্ন কিছু। যা হয়তো-বা ঘুণাক্ষরেও কারো মনে আসতো না, তেমন একটা কাজ তিনি করেছিলেন সেদিন।
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়েই ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ শুরু করে। আরব-ভূমির বাইরেও মুসলিমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়তে থাকে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। যেহেতু দ্বীনের মশাল পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, তাই নতুন করে যারাই ইসলামকে আপন করে নিচ্ছিলো আপন আলয় হিশেবে, তাদের মাঝে দ্বীনের বার্তাটুকু এবং আসমানি আলোর প্রভাটুকু বিলিয়ে দিতে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার অনেক সাহাবিকে দীক্ষা দিয়ে ওই-সমস্ত অঞ্চলগুলোতে পাঠিয়েছিলেন। তারা কুরআনের সুমহান বার্তা, রিসালাতের অমিয় বাণী মানুষের দ্বারে দ্বারে, যেভাবে নবিজির কাছ থেকে তারা রপ্ত করেছিলেন, সেভাবেই তাদের কাছে পৌঁছে দিতেন।
কিন্তু যখন প্রিয় নবিজির মৃত্যুসংবাদ তাদের কাছে পৌঁছালো, তারা কি আর সেখানে থাকতে পারেন? সবচেয়ে প্রিয় এবং সবচাইতে আপন মানুষটার বিদায়-বেলায় যদি হাজির না থাকা যায়, যদি চর্মচক্ষু দিয়ে প্রিয় মুখখানা শেষবারের মতন নাই-বা দেখা গেলো, তাহলে যে বন্ধুত্ব, যে ভ্রাতৃত্ব, যে প্রেম আর প্রণয়ের সম্মেলন হয়েছিলো হৃদয়ে, তা কি অপূর্ণতার গ্লানিতে ভরে উঠবে না?
তাই নবিজিকে শেষবারের মতন বিদায় জানাতে, শেষ দেখাটুকু দেখতে এসেছিলেন সাহাবিরা। যারা দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন, তারা দলে দলে আসতে লাগলেন প্রিয় নবিকে ‘আল-বিদা’ জানাতে।
নবিজির প্রয়াণ-দিনে শোকে একেবারে আবিষ্ট হয়েও আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু ভাবলেন–দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়া সাহাবিরা যখন নবিজিকে শেষ দেখা দেখতে মদিনায় ফিরছে, তাহলে জীবিত সব সাহাবিকে একত্রে, একসাথে পাওয়ার এই তো সুযোগ! এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে, এমনটা বলা যায় না কোনোভাবে। আজ এমনসব সাহাবিরা মদিনায় ফিরছেন, যারা নবিজিকে কাছ থেকে দেখেছেন, নবিজির কাছ থেকে শিখেছেন। কুড়িয়ে নিয়েছেন রত্নের আকর। যেহেতু সবাই আজ দলে দলে মদিনায় ফিরে আসছেন, তাই নবিজির কাছ থেকে তারা যা পেয়েছেন, তা কুড়িয়ে নেওয়ার, সংগ্রহ করে ফেলার এই তো সুবর্ণ সুযোগ!
জ্ঞান অর্জনের প্রতি কতটা প্রবল আগ্রহ, অনির্বাণ ইচ্ছে, অদম্য প্রেরণা থাকলে এমন বেদনাহত দিনেও এমনকিছু কেউ ভাবতে পারে? অন্য কোনো সাহাবির মানসপটে যে ভাবনার বিন্দুবিসর্গ পর্যন্ত ছিলো না, তা-ই কিনা ভেবে বসলেন মাত্র তেরো বছরের এক কিশোর!
তবে এ কথা ভাববার অবকাশ নেই যে–আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রয়াণে কাতর ছিলেন না। অন্য সবার মতন তিনিও শোকাহত ছিলেন। নবিজির বিদায়ে তারও হৃদয় ভেঙে চৌচির। এই বিপর্যয়ে তার মনেও কালবোশেখির ঝড়, কিন্তু সেই শোকের আবহ থেকে, সেই কালবোশেখির অন্ধকারেও তিনি জ্ঞান অর্জনের চিন্তা থেকে নিবৃত হননি৷ বিপদের মাঝেও তিনি আশা খুঁজে নিতে চেয়েছেন। শোকের মাঝেও খুঁজে নিতে চেয়েছেন সান্ত্বনার বস্তু।
তিনি ভেবেছিলেন–মদিনার বাইরে ছড়িয়ে পড়া সাহাবিরা, তাদের মাঝে এমন জ্ঞানের সন্ধান মিলতে পারে, যা হয়তো-বা আমার জানা নেই। হতে পারে–নবিজির কাছ থেকে তারা এমনসব জ্ঞান আহরণ করেছিলেন, যা আর অন্য কেউ জানে না। এই সুযোগে আমি যদি তাদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের কাছ থেকে সেই দুর্লভ মণিহার আহরণ করে নিতে পারি, তাহলে আমার জানার জগৎ আরো সমৃদ্ধ, আরো পোক্ত হবে।
তিনি তা-ই করলেন। নবিজির মৃত্যু উপলক্ষে মদিনার বাইরে থেকে আগত অসংখ্য সাহাবির দরোজায় দরোজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস। তাদের বলতেন, ‘আমি ইবনু আব্বাস। আমি জানি আপনি নবিজির প্রিয় একজন সাহাবি। আপনি তো দিন কয়েক বাদেই মদিনা ছেড়ে চলে যাবেন, তাই আমি আপনার কাছ থেকে এই ফাঁকে কিছু শিখতে এসেছি। আপনি আমাকে এমনকিছু শেখান, যা নবিজি আপনাকে শিখিয়েছেন। হতে পারে, আপনার আহরিত জ্ঞানে এমন অসংখ্য মণি-মুক্তো আছে, যা আমার জানা নেই। আমি শিখতে চাই।’[10]
তেরো বছরের এক কিশোর, যার স্বভাব-স্নিগ্ধ কোমল চেহারা থেকে এখনো মোছেনি কৈশোরের দ্যুতি, সেই বালক জ্ঞানের তৃয়া নিবারণের তাগিদে কী অদম্য প্রয়াসেই না মানুষের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিতে এলো!
ইনিই সেই আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু, যিনি কুরআনের তাফসির করার জন্য ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাকে বলা হয় তাফসিরকারকদের শিরোমণি। তাফসিরশাস্ত্রে তার মতন প্রজ্ঞা আর পাণ্ডিত্য আর কারো মাঝেই ছিলো না। পৃথিবীর যেখানেই, যে-কেউই কুরআনের তাফসির করতে গেলে, তাকে অবশ্যই অবশ্যই আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুকে সামনে রাখতে হবে। তার মত ডিঙিয়ে তাফসির করা একপ্রকার অসম্ভব। জ্ঞান অর্জনে তার যে ব্রত ছিলো, যে অনির্বাণ, অনিঃশেষ স্পৃহা নিজের মাঝে তিনি ধারণ করেছিলেন, তা-ই তাকে এই মর্যাদায় আসীন করেছে নিঃসন্দেহে।