অহংকার, আত্মমুগ্ধতা, আত্মম্ভরিতা একটা খাদের নাম। এই খাদে একবার পড়ে গেলে ফিরে আসাটা দুঃসাধ্য হয়ে যায়। তাই, আমাদের উচিত কখনোই আত্মবিমুগ্ধ না হওয়া, আত্মম্ভরিতায় না ভাসা। নিজের যোগ্যতাকে এমনভাবে প্রকাশ না করা, এমনকিছু না ভাবা যেখানে অহংকারের ছাপ ফুটে ওঠে। নিজের যোগ্যতার জন্য আমরা যেন আল্লাহর কাছে আরো বেশি কৃতজ্ঞ, আরো বেশি অনুগত আর বিনয়ী হতে পারি। যদি কখনো মনে হয় আমরা কিছু অর্জন করেছি বা করতে যাচ্ছি, তখনই আমরা যেন আল্লাহর দিকে ফিরে আসি। অধিক হারে আল্লাহর তাসবিহ তথা তাঁর প্রশংসা করি এবং নিজেদের যাবতীয় ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করি। মনে রাখতে হবে– অহংকারী ব্যক্তি কেবল অহংকার করে না, নিজের পতনের আয়োজনটাও করতে থাকে।
০৫. বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর
এক.
বনশ্রীর যে বাসায় আমি থাকতাম, ও বাসার নিচে আমার স্ত্রী এক হাফিযা মহিলার কাছে প্রতিদিন সকালে হিফয করতে যেতেন। তাদের সাথে, এক থুরথুরে বৃদ্ধ মহিলা, বয়স কম করে হলেও সত্তর-পঁচাত্তরের কোঠায়, দেখতাম তিনিও রোজ কুঁজো হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে চলে আসতেন আরবি পড়তে। আরবি পড়া মানে একেবারে আলিফ, বা দিয়ে শুরু করা। এমন বয়সে একজন অতি-বৃদ্ধা মহিলা রোজ নিয়ম করে শিশুদের মতন কায়দা পড়ছে–তা দেখে শুরুর দিকে আমি খানিকটা বিস্মিত হয়েছিলাম বৈকি! কিন্তু পরে বৃদ্ধা মহিলার কুরআন দেখে দেখে পড়তে পারার যে অদম্য স্পৃহা, তা দেখে ভেতরটা সম্মান আর শ্রদ্ধায় কানায় কানায় ভরে উঠলো।
আমাদের একটা বাতিক আছে। বয়স কম থাকলে আমরা বলি, এই বয়সেই তোমাকে কেন ওসব শিখতে হবে বাপু? জীবন তো এখনো অ-নে-ক পড়ে আছে। বয়স বাড়ুক, আস্তে আস্তে না হয় শিখবে।
আবার যাদের বয়স বেড়ে গেছে, তারা ভাবে, জীবনের আর কটা দিনই তো বাকি! এই জীবন-সায়াহ্নে বসে আমি আর কী এমন শিখতে পারবো? সময় যে ভারি অল্প।
আমার ধারণা, ওপরের এই দুই ভাবনাই শয়তানের প্ররোচনা। শয়তান ভালো মানুষের মতন, দেখতে ভালো এবং যৌক্তিক ধারণা দুটো মানুষের মস্তিষ্কে এমনভাবে গেঁথে দেয়, যেন সে জ্ঞান অর্জনে নিজেকে ডুবিয়ে না রাখে। মানুষকে জ্ঞান আহরণের রাস্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে শয়তান ‘এখনো বয়স হয়নি কিংবা আর কি সময় আছে?’–ধরনের প্ররোচনাগুলোকে আমাদের সামনে রঙচঙ মাখিয়ে উপস্থাপন করে, যাতে আমরা বিভ্রান্ত হই এবং জ্ঞানের সাগরে ডুব না দিতে পারি।
আমি এমন অনেককে চিনি, যারা শয়তানের এই প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়ে জ্ঞান আহরণের চেষ্টায় নিবিড়ভাবে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। আমার বাবার বয়সী অনেক মানুষকে চিনি, যারা সারাদিনের কাজকর্ম সেরে, সন্ধ্যার অবসরে আরবি ভাষা শেখার জন্য হয়তো-বা অনলাইন কোর্স কিংবা অফলাইন ক্লাশে গিয়ে খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়েন। আমি এমন অনেক জুনিয়র ভাই-বন্ধুকে চিনি, যারা জ্ঞান অর্জনের প্রতিযোগিতায়, শেখার প্রতিযোগিতায়, নিজেকে সমৃদ্ধ করার দৌড়ে আমার চাইতে আলোকবর্ষ এগিয়ে। তাফসির, হাদিস, ফিকহ, ইতিহাস, সাহিত্যে তারা আমার চেয়ে ঢের অগ্রগামী। এই দুই ভিন্ন বয়সী, যারা শেষে এসেও হতোদ্যম হয়নি, আর যারা আগেভাগেই নিজেদেরকে নিয়ে এসেছে সঠিক স্রোতে, তাদের উভয়ের জন্যই আমার অফুরান ভালোবাসা।
দুই.
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু নিঃসন্দেহে এই উম্মাহর জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। মানবজাতি এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি না আগে কখনো হয়েছে, না পরে আর হবে। আসমান থেকে প্লাবিত হয়েছে রহমতের যে ফল্গুধারা, যাকে বিশ্বমানবতার জন্য মুক্তি-দূত বানিয়ে পাঠানো হয়েছে, তার মৃত্যু অতি অবশ্যই আমাদের জন্য এক বিশাল ধাক্কা! আসমানি এই রহমত কখনো ফুরিয়ে যেতে পারে, কখনো তা মৃত্যুর হাত ধরে অলক্ষ্যে চলে যেতে পারে, এই ভাবনাটুকুও অনেক সাহাবি ভাবতে পারতেন না। তাই তো আমরা দেখি, নবিজির প্রয়াণ-দিবসে, নবিজিকে মৃত্যুর বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে হতবিহ্বল চিত্তে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন, ‘কখনোই নয়। নবিজি তো মৃত্যুবরণ করতেই পারেন না। যে বলবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু হয়েছে, তাকেই আমি হত্যা করবো।
প্রিয়মুখ, প্রিয়জন গত হলে আমরা যেভাবে ভেঙে পড়ি, শোকের সাগরে হাবুডুবু খাই, সাহাবিদের জন্য নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু-দিনটাও ছিলো এমনই এক ঘোরতর শোকের সময়; কিন্তু সেদিন শোক আর বিষণ্ণতার মাঝেও, দুঃখ আর দুঃসহ যন্ত্রণার দিনে এমন এক সাহাবি ছিলেন, যিনি সবকিছু সত্ত্বেও, সবকিছুকে ছাপিয়ে একটি অনন্য দিকেও নিবদ্ধ রেখেছিলেন নিজের সবটুকু মনোযোগ। তার নাম আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু।নবিজির চাচা আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর সন্তান। নবিজির মৃত্যুকালে আবদুল্লাহর বয়স ছিলো মাত্র তেরো বছর। শৈশবের পাঠ চুকিয়ে কৈশোরে পা রাখা এক দুরন্ত বালক আবদুল্লাহ। তিনি ছিলেন নবিজির বিশেষ স্নেহধন্যদের একজন। শিশুদের সাথে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিষ্টি-মধুর সম্পর্কের কথা তো সর্বজনবিদিত। তার ওপর নিজের পরিবারের একজন হওয়ায় আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস নবিজিকে কাছে পেয়েছিলেন অন্যদের চাইতে অনেক বেশি। খুব কাছ থেকে নবিজিকে দেখা, তার কথা শোনা, তার কাছ থেকে জ্ঞান আহরণের এক অনুপম ও অনন্য সুযোগ ছিলো ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর সামনে এবং তা তিনি হেলায় নষ্ট করেননি মোটেও।