আবু ওয়াহাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আমি আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের কাছে অহংকার সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘যখন তুমি লোকদের ব্যাপারে বিদ্রূপ করো, তা-ই হলো অহংকার। আমি বললাম, ‘আত্মম্ভরিতা কি?’ তিনি বললেন, ‘যখন তুমি ভাব যে, তুমি এমন কিছু করো, যা আর কেউ করে না।[6]
আত্মম্ভরিতা বিপদ ডেকে আনে। ভালো আমলগুলোকে রিয়ায় পরিণত করে। যখনই মানুষ নিজের আমল-ইবাদতের ব্যাপারে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, তখনই তার পা ফসকে যায়। সাফা পর্বতে দাঁড়িয়ে আবদুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু দুআ করতেন আর বলতেন, ‘ইয়া আল্লাহ, আপনি বলেছেন, ‘আমাকে ডাকো–আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো’, আর আপনি তো কখনোই আপনার ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। তাই আজ আমি করজোড়ে আপনাকে ডাকছি, আমার কাছ থেকে আমার দ্বীনকে ছিনিয়ে নেবেন না এবং মুসলিম হয়েই যেন আমি মৃত্যুবরণ করতে পারি।[7]
নবিজির একজন সাহাবি যদি এভাবে দুআ করতে পারেন, যদি তিনি দ্বীন থেকে বিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা করতে পারেন, মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করার ভয়ে তিনি যদি ভীত হতে পারেন, আমরা কেমন ঈমানদার আর তাকওয়াবান যে, নিজেদের আমল-ইবাদত নিয়ে হরহামেশা আত্মম্ভরিতায় ভুগবো? নিজেদের আমলকে, নিজেদের ইবাদত, যাবতীয় রাত্রি-জাগরণ, যাবতীয় ভালো কাজকে আবদুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর মতো সাহাবিরা ‘যথার্থ’ ও ‘যথেষ্ট ভাবতে পারেননি। নবিজিকে সামনে থেকে দেখেও তারা নিজেদের নিয়ে সন্তুষ্ট ও নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। আর একটু আমল করতে শুরু করলেই নিজেকে ছাড়া আশপাশের সবাইকে আমরা কিনা গাফিল, উদাসীন আর বিস্মৃত ভাবতে শুরু করি!
হিদায়াত আল্লাহর দেওয়া বড় একটা নিয়ামত। আত্মম্ভরিতা সেই নিয়ামতের রাস্তাকে করে তোলে রুক্ষ ও খড়খড়ে। আমল-ইবাদতের ব্যাপারে অধিক পরিমাণ আত্মবিশ্বাস, অধিক আত্মম্ভরিতা আমাদের এটা ভুলিয়ে দেয়–যেকোনো মুহূর্তেই আমরা পা ফসকে পড়ে যেতে পারি, যেকোনো মুহূর্তেই দ্বীন থেকে আমরা ছিটকে যেতে পারি। একজন হিদায়াতপ্রাপ্ত লোক যে আজীবন হিদায়াতের রাস্তায় অবিচল থাকবে, তার যে পথ হারাবার কোনো আশঙ্কা থাকবে না–এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। আবার হিদায়াত পায়নি এমন লোকও যে আজীবন হিদায়াতের বাইরে থেকে যাবে, এমন ধারণারও কোনো অবকাশ নেই। তাই হিদায়াতপ্রাপ্ত লোক যেমন আত্মগৌরব, আত্মম্ভরিতায় ভুগবে না, তেমনি দৃশ্যত হিদায়াতের রাস্তায় নেই এমন লোককেও কটাক্ষ করা, ছোট করে দেখা সমীচীন নয়।
উম্মু সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন স্ত্রী। তার কাছে যখন জানতে চাওয়া হলো, কোন সে দুআ, যা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবচেয়ে বেশি করতেন?
তিনি বললেন, ‘নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবচেয়ে বেশি পড়তেন এই দুআটা–ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুব, সাব্বিত কালবি আলা দ্বীনিক। অর্থাৎ–হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী, আপনি আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের ওপর অবিচল রাখুন।[8]
অন্তরকে দ্বীনের ওপর দৃঢ় রাখা মানে হলো–অন্তর যেন দ্বীন থেকে কখনোই সরে
যায়। যেন সর্বদা হিদায়াতের রাস্তায় আমরা থাকতে পারি। মানুষের অন্তরের অবস্থা যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে। যেকোনো সময় অন্তর ঝুঁকতে পারে এমনসব দিকে, যা আমাদেরকে দ্বীনের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়। এজন্যই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবচেয়ে বেশি পরিমাণে যে দুআটা করতেন, তা
এই অন্তরকে দ্বীনে স্থির রাখা বিষয়ক। আমাদের অন্তরের অবস্থা নবিজি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি এমন একটা দুআ আমাদের শিখিয়ে গেছেন। যেখানে অন্তরের স্থিরাবস্থার কোনো নিশ্চয়তা নেই, সেখানে আমল নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার, বেপরোয়া আর অহংকারী হয়ে ওঠার তো প্রশ্নই আসে না।
শাইখ সালিহ আল-উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘সর্বপ্রথম আমি নিজেকে উপদেশ দিই এবং অন্যদেরও বলি যে, দ্বীনের পথে অটল-অবিচল থাকার জন্য সর্বদা আল্লাহর কাছে মিনতি করুন। কারণ আমাদের প্রত্যেকের পায়ের তলায় লুকিয়ে আছে ফাঁদ। আল্লাহ যদি আমাদের দ্বীনের ওপর অবিচল না রাখেন, নিশ্চিতভাবে আমরা সেই ফাঁদে আটকে যাবো এবং ধ্বংস হবো।[9]
পাঁচ
আমাদের আমলগুলো যেন আমাদের বেপরোয়া না করে তুলে। অহংকারে মোড়া আমলের কোনো মূল্য আল্লাহর কাছে নেই। অহংকার-বিহীন কম আমল অহংকারে ভরা অধিক আমলের চাইতে ঢের উত্তম। অহংকার আর বিনয় একসাথে থাকতে পারে না, যেভাবে মিশে থাকতে পারে না তেল আর জল।
অহংকার অন্তরে প্রবেশ করলে আমাদের ভেতর থেকে সর্বপ্রথম যে জিনিসটা বিলুপ্ত হয়ে যায় তা হলো বিনয়। ইবলিসের অন্তরে অহংকার ঢুকেছিলো। সে নিজের ব্যাপারে এতই বেশি আত্মবিমুগ্ধ ছিলো যে আল্লাহর আদেশ পর্যন্ত সে অমান্য করলো। আত্মম্ভরিতা ইবলিসকে অভিশপ্তর পথে নিয়ে গেলো।
আবার, যখন অন্তরে বিনয় প্রবেশ করে, আমাদের ভেতর থেকে সবার আগে যে জিনিসটা ধূলিসাৎ হয়ে যায় তা হলো অহংকার। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আদম আলাইহিস সালাম। ইবলিসের ধোঁকায় পড়ে, আদম আলাইহিস সালাম এবং হাওয়া আলাইহাস সালাম জান্নাতের নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে ফেললে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদের পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। আদম আলাইহিস সালাম ভুল করেছেন ঠিক, কিন্তু সেই ভুলের ওপর স্থির থাকেননি। সেই ভুলের ওপর গো ধরে বসে থাকেননি। সেই ভুলটাকে তিনি সঠিক প্রতীয়মান করতে উদ্যোগী হোননি৷ বরং, ভুলটাকে ভুল হিশেবে জেনে এবং মেনে নিয়ে তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। নিজেদের কৃত ওয়াদা-চ্যুত হয়ে তারা যে ভুল করেছিলেন তা স্বীকার করে, আল্লাহর করুণা ভিক্ষা করে মাফ চাইলেন তারা, এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদের মাফ করে দেন। অন্তরে বিনয় ছিলো বলেই তারা আল্লাহর কাছে নত হতে পেরেছিলেন। আর, বিনয়ের অভাবেই ইবলিস আল্লাহর কাছে নতি স্বীকার করতে পারেনি।