পাঁচ.
এক বন্ধুর বাসায় ছিলো আমার অবাধ যাতায়াত। রোজকার আজ্ঞা, বিভিন্ন বিষয়ে শলা-পরামর্শসহ নানান কারণে তার বাসায় যাওয়াটা একপ্রকার আমার রুটিনে পরিণত হলো। বন্ধুটার বিয়ের পরে প্রথম যেদিন তার বাসায় আসি, দরোজার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রথমেই খানিকটা থতমত খেলাম। তার বাসার দরোজায় সাদা কাগজের ওপরে গোটা গোটা অক্ষরে কুরআনের একখানা আয়াত লেখা। আয়াতটা ছিলো–
হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্যকারো ঘরে প্রবেশ কোরো না, যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি নেবে এবং ঘরের লোকদের সালাম দেবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।(5)
এমন নয় যে এই আয়াত আগে কখনোই পড়িনি কিংবা আমার চোখে পড়েনি, কিন্তু সেদিন তার ঘরের দরোজায় এমনভাবে আয়াতখানা সাঁটানো দেখে মনে হলো– আমি বুঝি এই আয়াত সেদিন-ই প্রথম দেখলাম। বিনা অনুমতিতে কারো ঘরে প্রবেশের অনুমতি ইসলাম যে আমাকে দেয়নি, সেটা সেদিন যেন আমি নতুনভাবে অনুভব করতে পারলাম। এখন যে আমার বন্ধুর ঘরে একজন নারী আছে এবং ওই নারী যে আমার জন্য মাহরাম নয়, তার সামনে যাওয়ার অনুমতি আমার নেই–এই। আয়াতখানাই সেই নির্দেশটা আমাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
আমাদের গ্রাম-বাংলার আরো একটি চিরাচরিত দৃশ্য হচ্ছে এই–আমাদের চাচা, জেঠা, ফুফা, চাচাতো ভাই, মামাতো ভাইয়েরা আমাদের ঘরে এসে, আমাদের মা-বোন-স্ত্রীদের সাথে দিব্যি খোশালাপে মেতে ওঠে। বড় আফসোস এবং পরিতাপের বিষয় হলো, পর্দার সামান্য বালাইটুকু এখানে রক্ষা হয় না। একজন মুসলমান অপর মুসলমানের ঘরে আসতে হলে সবার আগে তাকে বাইরে থেকে, দৃষ্টি অবনত রেখে অনুমতি চেয়ে নিতে হবে। অনুমতি দেওয়া হলে তবেই সে ঘরে ঢুকতে পারবে, নতুবা নয়। এই কথা আমার নয়, স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই বিষয়ে কুরআনে দুইটা আয়াত নাযিল করেছেন।
হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্যকারো ঘরে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি নেবে এবং ঘরের লোকদের সালাম দেবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো। অতঃপর, যদি তোমরা সেখানে কাউকে না পাও, তাহলে তোমাদেরকে অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা সেখানে প্রবেশ কোরো না। আর যদি তোমাদেরকে বলা হয়, ‘ফিরে যাও, তাহলে তোমরা অবশ্যই ফিরে যাবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম। বস্তুত, তোমরা যা করো, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত।’[6]
এই যে আল্লাহর বেঁধে দেওয়া সীমারেখা, নিয়ম ও নীতিমালা–এসব মেনে চলার কোনো বালাই কি আমাদের গ্রাম-বাংলা এবং আধুনিক মুসলিম পরিবারগুলোতে আছে? আমাদের বন্ধুরা, অফিসের কলিগ, ছেলে-মেয়ের স্কুলশিক্ষকেরা কত সহজে আমাদের ঘরগুলোতে ঢুকে পড়তে পারেন। না কোনো অনুমতির দরকার পড়ে, না দরকার পড়ে কোনো পর্দার। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে–আমাদের মায়েরা, স্ত্রী ও বোনেরা দরোজার কাছে এসে হাসিমুখে এসমস্ত নন-মাহরাম, পর-পুরুষদের সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে যান। অথচ একজন মুসলিম নারীর উচিত নয় কোনোভাবে একজন পর-পুরুষ, যে তার মাহরাম নয়, সরাসরি রক্ত-সম্পর্কের কেউ নয়, তার সামনে যাওয়া। বাসায় স্বামী, সন্তান কিংবা বাবার অনুপস্থিতিতে যদি কোনো পর-পুরুষ আসে, দরোজার অভ্যন্তর থেকেই তার সাথে কথা বলে নেওয়া উচিত। যদি তার কোনো দরকার থাকে, তাহলে তাকে এমন সময়ে আসতে বলা যখন বাসায় কোনো মাহরামের উপস্থিতি থাকবে। তেমনি আমরা যখন কারো বাসায় যাবো, তখন আগে বাইরে থেকে সালাম দিয়ে অনুমতি চেয়ে নেবো। যদি বাসায় কোনো পুরুষ না থাকে, তাহলে আমাদের উচিত হবে না ওই বাসায় যাওয়া। ওই বাসায় কোনো মাহরাম পুরুষ উপস্থিত থাকলে তখন যাওয়াটাই অধিকতর উত্তম। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মুমিনদের শিখিয়ে দিচ্ছিলেন, নবিজির স্ত্রীদের কাছ থেকে কোনো জিনিস চাইতে হলে কীভাবে চাইতে হবে–
তার স্ত্রীদের কাছ থেকে কিছু চাইতে হলে পর্দার অন্তরাল থেকে চাও। এই বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ। [7]
কারো বাসায় যদি কোনো পুরুষ উপস্থিত না থাকে, আপনি ওই বাসায় যাবেন না। কিছু চাইতে হলে তা পর্দার অন্তরালে থেকে চাওয়ার কথা আল্লাহ আপনাকে জানাচ্ছেন। আপনি যদি একজন নারী হন, মাহরাম নয় এমন কোনো পুরুষ আপনার বাসায় এলে আপনি তার সাথে পর্দার অন্তরাল থেকেই কথা বলুন। এটাই আল্লাহর বেঁধে দেওয়া সীমারেখা। এটা আমাদের অন্তরের পবিত্রতার জন্যই। দুজন নারী-পুরুষ, যারা সম্পর্কে রক্তের কেউ নয়, কেউ কারো মাহরাম নয়, তারা যখন একান্তে খোশালাপ করে, শয়তান সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিশেবে উপস্থিত হয়ে যায়। অন্তরে যত ধরনের কুটিল চিন্তা, কুৎসিত ভাবনা দেওয়া যায়, সব সে আপনার মনে ঢেলে দেবে। কারণ সে চায় আপনি পথভ্রষ্ট হোন। সে তো আপনাকে পথভ্রষ্ট করবে বলেই আল্লাহর সামনে ওয়াদা করেছিলো। শয়তানকে সুযোগ না দেওয়ার জন্যই, নিজের অন্তরের পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে, সর্বোপরি নিজেকে হিফাযতের উদ্দেশেই আপনার উচিত নয় নন-মাহরাম কারো বাসায় গিয়ে তার সাথে দেখা করা, গল্প-গুজব-আড্ডা দেওয়া।