মহিলাকে তো কাজও করতে হবে, অন্যদিকে পর্দাও করতে হবে। পর-পুরুষের নজর থেকে বাঁচাতে হবে নিজেকে। তাই সেই কাঠফাটা রোদের মাঝেও তিনি নিজের পর্দার ব্যাপারে এতটুকু ছাড় দেননি। এই যে ত্যাগের গল্প, এই গল্পকে আপনি কিন্তু বস্তুবাদের কোনো প্যারামিটার দিয়েই মাপতে পারবেন না। এই ত্যাগের তৃপ্তি ওই মহিলা বুঝবে না, যার কাছে পর্দাটা নিছক ফ্যাশন কিংবা আহ্বাদের বিষয়। ওই মহিলাও বুঝবে না, যার কাছে পর্দাটা একপ্রকার বোঝা। এই ত্যাগের মর্ম ওই পুরুষ বুঝবে না, যে নিজের মা, স্ত্রী, বোন, কন্যার পর্দার ব্যাপারে সচেতন নয়; যে মনে করে তার স্ত্রী-কন্যা আর বোনেরা পর-পুরুষদের সাথে। মিশলে, কথা বললে, খোশালাপে মজলে দুনিয়া উল্টে যাবে না।
চার.
আমাদের আরো একটা ব্যামো আছে। আমরা যখন পর্দার কথা বলি, পর্দা সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা করি, তখন আমাদের মানসপটে জ্বলজ্বল করে একটা বোরকা পরা নারীমূর্তির ছবি ভেসে উঠে। আমরা, পুরুষেরা ধরেই নিয়েছি, পর্দাটা কেবল নারীদের জন্যই। পুরুষের আবার পর্দা কী? দুঃখের ব্যাপার হলো–পর্দা বলতে আমরা কেবল বোরকা-হিজাবকেই ভাবতে শিখেছি। দৃষ্টিরও যে পর্দা আছে, শ্রবণেরও যে পর্দা থাকে, তা কি আমরা কখনো জানতে চেয়েছি?
কুরআনে সুরা নুরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পর্দার বিধান নাযিল করেছেন। মজার ব্যাপার হলো–সুরা নুরের পর্দা-সংক্রান্ত প্রথম আয়াতটাই পুরুষদের উদ্দেশ্য করে বলা এবং ওই আয়াতে প্রধানত পুরুষদেরকে দৃষ্টির ও লজ্জাস্থানের হিফাযত করতেই বলা হয়েছে। কুরআন যখন পর্দার বিধান নাযিল করেছে, সবার আগে পুরুষদেরকে উদ্দেশ্য করে কথা বলেছে, কিন্তু অতীব দুঃখের ব্যাপার হলো এই আজকের সময়ে আমরা পর্দা বলতে যা কিছু বুঝি, সবকিছু একচেটিয়াভাবে নারীদের ওপরেই চাপিয়ে দিই।
পর্দাটা নারী ও পুরুষ দুজনার জন্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ফরয করেছেন। একজন নারী যেমন নিজেকে বোরকা আর হিজাবে আবৃত করবে, নিজের রূপ-লাবণ্যকে পর-পুরুষের দৃষ্টি থেকে বাঁচাবে, ঠিক একইভাবে একজন পুরুষও এমন পোশাক পরবে না, যা তার শরীরের গড়ন-গাড়নকে প্রকাশ করে দেয়। ঢিলেঢালা পোশাকই সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী। আজকাল আমরা দেখি, অনেক মুসলিম পুরুষেরা এমন ছিপছিপে শার্ট-প্যান্ট পরেন, যা তাদের শরীরের গড়নকে মেলে ধরে। আপাতদৃষ্টিতে এটাকে ফ্যাশান কিংবা যুগের চাহিদা যা-ই বলা হোক
কেন, এই ধরনের পোশাক নিজেকে এবং বিপরীত লিঙ্গের অন্য কাউকে যেকোনো মুহূর্তে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিতে পারে। পর্দার আবশ্যিকতা-ই হলো এই কারণে যে–পর্দা আপনার দেহকে প্রদর্শনেচ্ছা থেকে বাঁচাবে; কিন্তু আমরা যারা ছিপছিপে শার্ট-প্যান্ট পরি, যা শরীরের সাথে একেবারে লেপ্টে থাকে, তা আদতে কতখানি আমাদের প্রদর্শনেচ্ছা থেকে বাঁচায়, ভেবেছি কি?
ছিপছিপে শার্ট-প্যান্ট পরা যাবে কি না বা শারিয়ায় তা জায়েয কি না, সেসব আমার। আলোচনার বিষয় নয়। আসলে আমি এখানে যা বোঝাতে চাই, তা মোটাদাগে এই–সুন্নাহসম্মত পোশাকের অর্থই হলো তা আমাদের শরীরকে এমনভাবে ঢেকে রাখবে, যাতে কোনোভাবে আমাদের শরীরের গঠন, গড়ন প্রকাশ না পায়। আমাদের পোশাকের চেহারা যদি হিন্দি কিংবা তামিল সিনেমার নায়কের মতো হয়, তাহলে সেই পোশাক নিয়ে আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবার অবকাশ আছে বৈকি!
তবু প্রশ্ন থেকে যায়, এ ধরনের পোশাক পরলে কি কেউ গুনাহগার হবে? প্রশ্নটার উত্তর অন্যভাবে দেওয়া যাক। গুনাহগার হবে কি না, সেই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে উত্তম কিংবা অধিকতর উত্তমের কথা যদি আমরা চিন্তা করি, তাহলে হয়তো-বা এই ধরনের ছিপছিপে, গায়ে লেপ্টে থাকা পোশাক পরিধান না করাই উচিত।
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, যুহদের স্তর হচ্ছে তিনটা। মানে, আল্লাহকে ভয় করে, কিংবা আল্লাহকে ভালোবেসে একজন মানুষ তিনভাবে জীবনযাপন করে থাকে।
প্রথম স্তরের মানুষেরা কেবল যাবতীয় হারাম থেকে বেঁচে থাকে।
দ্বিতীয় স্তরের মানুষ হারাম থেকে তো বাঁচেই, হালালের মধ্যে যা অতিরিক্ত, তা থেকেও বিরত রাখে নিজেদের।
তৃতীয় এবং সর্বোচ্চ স্তরের মানুষ হালালের মধ্যেও এমন সব জিনিস এড়িয়ে চলে, যা সাধারণত আল্লাহর ভাবনা থেকে গাফেল করে দেয়।
এখন যদি ধরেও নিই, ছিপছিপে পোশাক পরিধানে কোনো অসুবিধে নেই, এটা জায়েয; তবু এটা তো নিশ্চিত যে–এই পোশাকের চেয়ে ঢিলেঢালা পোশাক-ই সুন্নাহর অধিক কাছাকাছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর অধিকতর প্রিয় হয়ে উঠতে চায় কিংবা আল্লাহকে বেশিই ভালোবাসতে চায়, তার কি উচিত নয়, এমন হালালের দিকে ঝুঁকে পড়া, যা অন্য একটা হালালের চাইতে অধিক উত্তম?
সাধারণত, বর্তমান জামানায় কিছু নারী যে স্টাইলিশ হিজাব পরে থাকেন, তা অবশ্যই সর্বসম্মতিক্রমে অপছন্দনীয়; কিন্তু আমরা যারা স্টাইলিশ হিজাব অপছন্দ করি, তারা যখন স্টাইলিশ শার্ট-প্যান্ট পরে, স্টাইলিশ হিজাবের বিরুদ্ধে বলতে যাবো, তখন কি আমাদের উচিত নয় আগে অন্তত একবার নিজের দিকে তাকানো?
আলোচনার সারবস্তু হলো–পুরুষেরও পর্দা আছে। পুরুষেরাও দৃষ্টির হিফাযত করবে এবং শালীন পোশাক পরিধান করবে, কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, পর্দার আয়াতে যেখানে আগে আমাদেরকে উদ্দেশ্য করেই কথা বলা হয়েছে, সেখানে আমরা পর্দার যাবতীয় হুকুম যেন নারীকুলের ওপরে চাপিয়ে দিতে পারলেই বেঁচে যাই।