মাছের পেটে বিলীন হয়ে ইউনুস আলাইহিস সালাম আল্লাহকে অভিযুক্ত করেননি। শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করে তার মা অভিযোগের তির ছুঁড়ে দেননি আল্লাহর দিকে। প্রিয়তম পুত্র ইউসুফকে হারিয়ে ভীষণ বিচ্ছেদে কাতর হয়ে পড়ার পরেও একটিবারের জন্য আল্লাহর ওপর থেকে ভরসা হারাননি নবি ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। তিনি এত কেঁদেছিলেন যে, তার চোখের জ্যোতি পর্যন্ত চলে গিয়েছিলো; কিন্তু অন্তরের গভীরে তার ছিলো আল্লাহর ওপর টইটম্বুর তাওয়াক্কুল। তিনি জানতেন–আল্লাহ নিশ্চয় একটা সুন্দর পরিণতির দিকে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।
জীবনের সাময়িক চিত্রনাট্যে বিলীন হয়ে যাবেন না। যে সুতোয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আপনার জীবনকে বাঁধতে চান, তাকে ধৈর্যের সাথে আলিঙ্গন করুন। বিশ্বাস করুন, রাত পোহালে একটা সুন্দর সকাল আপনার জীবনটাকেও রাঙিয়ে যাবে।
———-
[1] সুরা কাহফ, আয়াত : ৭০-৮২
[2] সহিহুল বুখারি : ৩৩৬৪; তাফসিরুত তাবারি, খণ্ড : ১৭; পৃষ্ঠা : ১৯; আস-সুনানুল কুবরা, বাইহাকি, খণ্ড : ১০; পৃষ্ঠা :১৬; তাফসিরুল বাগাভি, খণ্ড : ৪; পৃষ্ঠা : ৩৫৬
০৩. গাহি নতুনের গান
এক.
বাড়ি গেলে আজকাল ভীষণরকম মন খারাপ হয়। আমার বড় ভাইকে পইপই করে বুঝিয়ে বলেছিলাম কেন তার স্ত্রীর, অর্থাৎ আমার ভাবির উচিত নয় আমার সামনে আসা, আমার সাথে কথা বলা। যদি কথা বলতেই হয়–তাহলে সে যেন অবশ্যই যথাযথ পর্দার সাথে কথা বলে।
আমার ভাই আমার কথা হয়তো বুঝতে পারেননি অথবা আমি অধম তাকে বোঝাতে হয়তো উপযুপরি ব্যর্থ, যার দরুন বাড়ি গেলে এখনো আমাকে সেই আগের করুণ অবস্থার মধ্য দিয়েই যেতে হয়। কেবল তা-ই নয়, গ্রামের মহিলাদের মধ্যে পর্দার জ্ঞান একেবারে নেই বললেই চলে। পর্দা বলতে তারা কেবল বাইরে বেরোনোর সময় একটা ছিপছিপে বোরকা পরাকেই বুঝতে শিখেছে। মাহরাম ও নন-মাহরামের একটা সরল সীমারেখা যে ইসলামে বিদ্যমান, তার কিঞিৎ জ্ঞানও আমি গ্রামের অধিকাংশ মহিলার মাঝে দেখতে পাই না। দোষটা যে মোটাদাগে তাদের একার, তা কিন্তু নয়। দোষটা সমানভাবে আমাদেরও। আমরা তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে পারিনি। আমাদের জুমুআর খুতবাগুলোতে কিংবা ওয়াজ-মাহফিলগুলোতে গতানুগতিক আলোচনার বাইরে আমরা কখনোই পর্দা, মাহরাম নন-মাহরামের মতন ব্যাপারগুলো নিয়ে আলাপ করি না। নারী-পুরষের অবাধ মেলামেশার ব্যাপারে শারিয়ার টেনে দেওয়া যে সীমারেখা, সেই সীমারেখার আলাপ আমাদের আলোচনায় ভীষণভাবে অনুপস্থিত।
ফলে, আগে যেখানে আঁধার ছিলো, এখনো সেখানে ঘোর আঁধারের ঘরবসতি।
একটা কথা আমাদের সমাজে খুব প্রচলিত। লোকমুখে শুনি—‘বড় ভাবি মায়ের মতো।’ বড় ভাইয়ের বউকে মা জ্ঞান করার বিদ্যে নিয়ে আমাদের সমাজের অধিকাংশ মুসলিম শিশু বড় হয়ে ওঠে। দ্বীনের বুঝ আসার পরেই আমি বুঝতে পারলাম, কথাখানা কতখানি ভয়ানক! বড় ভাইয়ের বউ, যার সাথে আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই, যে ধর্মমতে আমার জন্য মাহরামও নয়, তাকে দেওয়া হয়েছে মায়ের সমান আসন! আমি এমন অনেকগুলো পরিবার সম্পর্কে জানি, যেখানে পরিবারের বড় ভাই বিদেশে আর ছোট ভাই বড় ভাইয়ের বউয়ের সাথে দিব্যি পরকীয়া করে বেড়াচ্ছে। বাঙালি মুসলিম সমাজে আজকাল এসব ব্যাপার এত সহজ আর খোলামেলা হয়ে উঠেছে যে–এগুলোকে এখন খুব গুরুতর অপরাধ হিশেবে দেখা হয় না। সমাজ যাকে তুলনা করেছে মায়ের সাথে, যাকে দিয়েছে মায়ের সমান মর্যাদা আর আসন, ঠিক তার সাথেই আবার পরকীয়া! কেমন অদ্ভুতুড়ে না?
কিন্তু এটাই নিরেট সত্য। বাঙালি মুসলিম সমাজে আজ পর্দা-প্রথার যে করুণ দশা, তা দেখলে দ্বীনের জন্য দরদ রাখে এমন যে-কারো বুক হুহু করে উঠবে। শুধু। তো বড় ভাইয়ের বউই নয়, আমাদের বড় ভাইয়েরা, যারা যথেষ্ট যত্নের সাথে বিয়ের পর শালিদের সঙ্গে যে মধুর ভাই-বোনের সম্পর্কটা পাতায়, সেটাও যে কতটা সাংঘাতিক, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে! এমন আরো বহু এবং নানাবিধ মধুর সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে আমাদের সমাজগুলো, যা দ্বীন ইসলাম কখনোই, কোনোভাবে, কোনোরূপে সমর্থন করে না।
দুই.
কুরআনে আমরা দেখি–মুসা আলাইহিস সালাম যখন নিরাশ্রয় অবস্থায় মাদইয়ানে আসেন, তখন একটা কূপের অদূরে দুটো রমণীকে তিনি দেখতে পান, যারা তাদের বকরিগুলোকে নিয়ে একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। কূপ থেকে পানি নেওয়ার বদলে জড়তা নিয়ে অদূরে তাদের দাঁড়িয়ে থাকবার কারণ মুসা আলাইহিস সালামের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠলো।
তখন কূপের কাছে ছিলো কয়েকজন পুরুষ, যারা নিজেদের প্রয়োজনের পানি কূপ থেকে তুলে নিচ্ছিলো। যেহেতু কূপের কাছে পুরুষদের আনাগোনা, ফলে মেয়েদুটো সেই আনাগোনার মাঝে নিজেদের হাজির করার চাইতে অদূরে দাঁড়িয়ে পুরুষদের প্রস্থানের জন্য অপেক্ষা করাটাকেই শ্রেয় মনে করলো।[1]
আচ্ছা, পুরুষদের পাশাপাশি মেয়ে দুটোও যদি কূপের কাছে গিয়ে পানি নেওয়ার জন্য তোড়জোড় আরম্ভ করতো, কী হতো তাহলে? তারা কি গিয়ে বলতে পারতো না, ‘ভাই, জায়গা দেন, আমরাও একটু পানি নিই?’
নিজের অধিকার ও দরকার সামলাবার জন্য এভাবে পুরুষদের সাথে বাদানুবাদে জড়ালে কোনো ক্ষতি ছিলো কি? আসলে ক্ষতি ছিলো কি না, তা বলা যায় না; তবে দ্বীনের উত্তম পন্থা যে লঙ্ঘন হতো, নিশ্চিতভাবে বলা যায়। আপনি বলতে পারেন–এখানে উত্তম পন্থা কোনটা তাহলে? নিজের অধিকারটুকু ছেড়ে দিয়ে অন্যকে সুযোগ করে দেওয়া? সেটাও নয়। এখানে মূল বিষয়টা লজ্জা তথা– রমণীয় গুণের!