এটাই হলো সেই প্রাপ্তি, যা আল্লাহর পরিকল্পনায় ভরসা রাখলে পাওয়া যায়। তিনি হয়তো মাঝে মাঝে আমাদের কষ্টে রাখেন, হয়তো-বা মাঝে মাঝে আমাদেরকে তিনি কোনো বিয়োগ-ব্যথা, কোনো বিচ্ছেদ-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে নিয়ে যান। কোনো আর্থিক-শারীরিক ক্ষতি হয়তো-বা আমাদের হয়ে থাকে, কিন্তু যখনই আমাদের ভরসার পারদ হাজেরা আলাইহাস সালামের স্তরে উন্নীত হবে, যখনই মন থেকে এই বিশ্বাসের সুর প্রতিধ্বনিত হবে যে, নিশ্চয় আমার রব আমাকে তার দয়া থেকে বঞ্চিত করবেন না, তখনই আমাদের জন্য খুলে যাবে আসমানের দরোজা। আমাদের ধৈর্যের, আমাদের ত্যাগের, আমাদের সকল দুঃখ আর কষ্টের বিনিময়ে তখন এমন প্রাপ্তির বন্দোবস্ত করা হবে, যা স্বপ্নেরও অতীত!
শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে হত্যার জন্য যখন ফিরআউন বাহিনী পাগলপারা, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাকে বাকসো-বন্দি করে নদীতে নিক্ষেপ করার জন্য তার মাকে নির্দেশ দিলেন। একজন মায়ের কাছে কোলের শিশুকে নদীতে নিক্ষেপ করবার মতন কঠিন কাজ দুনিয়ায় আর কী হতে পারে? ভয়, শঙ্কা আর বিহ্বলতায় অস্থির হয়ে যাওয়া মুসা আলাইহিস সালামের মা যখন আল্লাহর আশ্বাসবাণী পেলেন, যখন শুনলেন, তার কোলের মানিককে তার-ই কাছে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তখনই তার হৃদয়ের সমস্ত ভয়, সমস্ত দ্বিধা কেটে যায়। আল্লাহর কোনো এক পরিকল্পনার অংশ যে তার শিশুপুত্র হতে যাচ্ছে–তা তিনি বুঝে যান সাথে সাথেই। ফলে সেই পরিকল্পনা থেকে ছিটকে না গিয়ে বরং বিপুল আগ্রহে তিনি তাতে জড়িয়ে গেলেন।
তার পরের ঘটনাও আমাদের জানা। মুসা আলাইহিস সালাম বিপুল-বিক্রমে তার মায়ের কাছে ফিরেছিলেন। তার কাছে পদানত হয়েছিলো দোর্দণ্ড প্রতাপের ফিরআউন বাহিনী। সেদিন মায়ের কাছে শুধু সন্তানকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি; বরং তাকে একজন প্রসিদ্ধ নবির মর্যাদা দান করা হয়েছে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের জীবনকে নিয়ে যে ছক আঁকেন, তাতে পরিপূর্ণ বিশ্বাস এনে, তা থেকে কল্যাণ এবং দয়া কামনা করে নিজের চেষ্টাটুকু যদি করে যাওয়া যায়–যেভাবে হাজেরা আলাইহাস সালাম করে গিয়েছিলেন মক্কার একাকী নির্জন প্রান্তরে শিশু ইসমাইল আলাইহিস সালামকে নিয়ে, যেভাবে মুসা আলাইহিস সালামের মাতা করেছিলেন ফিরআউন বাহিনীর বিপরীতে–তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, জীবনের কোনো এক পর্যায়ে সেই চেষ্টার, সেই ত্যাগের, সেই ধৈর্যের ফল আমরা অবশ্যই পাব। দুনিয়াতে অথবা অনন্ত আখিরাতে।
চার.
নবি ইউসুফ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মিশরের মন্ত্রীর পদে আসীন করেছেন; কিন্তু দেখুন–মর্যাদার এই স্তরে উন্নীত করতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইউসুফ আলাইহিস সালামকে কত তীব্র পরীক্ষার মুখোমুখি করেছিলেন। ছোটোবেলায় ভাইদের দ্বারা অন্ধকারকূপে নিক্ষিপ্ত হওয়া, বণিকদলের দ্বারা অন্যত্র ক্রীতদাস হিশেবে বিক্রি হয়ে যাওয়া, বাদশাহর স্ত্রীর অশালীন প্রলোভন এবং সর্বোপরি জেল! কী এক তীব্র সংকট আর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই না কেটেছে নবি ইউসুফ আলাইহিস সালামের সেই দিনগুলো!
কিন্তু দৃশ্যপটের শেষটা কেমন ছিলো?
আমরা জানি–ইউসুফ আলাইহিস সালাম জীবনের একটা পর্যায়ে এসে সেই সবকিছু পুনরায় ফিরে পেয়েছেন, যা তিনি একদিন হারিয়েছিলেন–তার দয়াময় বাবা, ভাই ও পরিবার। মিশরে একদিন অসহায় ক্রীতদাস হিশেবে যে বালক প্রবেশ করেছিলো, নির্দিষ্ট সময়ের পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাকে আসীন করে দিলেন সেখানকার অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পদে! তাকে নবুওয়াত দান করলেন এবং পৃথিবীতে অধিষ্ঠিত করলেন একজন সম্মানিত নবি হিশেবে! কী অসাধারণ প্রাপ্তি ছিলো সেগুলো!
মুসা আলাইহিস সালামের জন্য যিনি দরিয়ায় পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন, একদিন তিনিই কিন্তু আদেশ করেছিলেন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করার।
নবি ইউনুস আলাইহিস সালামের মাছের পেটের ভেতর থেকে বেঁচে আসাটা আমাদের পুলকিত করে, কিন্তু সেই পুলকের পেছনের কার্যকারণ কতখানি ভীতি-জাগানিয়া তা কি ভেবেছি কখনো?
গভীর সমুদ্রতলে, সেই বিশালকায় মাছের পেটে, যেখানে দুনিয়ার কোনো শব্দ, কোনো আওয়াজ পৌঁছে না, যেখানে বিস্তৃত জায়গাজুড়ে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার–এমন পরিস্থিতিতে আরশের অধিপতি নবি ইউনুস আলাইহিস সালামের জন্য যথেষ্ট হয়ে গেলেন।
তিনি যথেষ্ট হলেন ঠিকই, তবে নবি ইউনুস আলাইহিস সালামকে কঠিন একটা পরীক্ষার মুখোমুখি করার পরে।
আপনি হয়তো কোনো একটা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। হতে পারে সেই সংগ্রাম ভীষণ দুঃসহ! আপনি হয়তো প্রিয় কোনো মানুষকে জীবন থেকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণায় দন্ধ। কোনো অপ্রিয় বিচ্ছেদ-ব্যথায় হয়তো আপনি ভীষণ নাজেহাল। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো সমস্যা হয়তো আপনাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। হতে পারে জীবন আপনার ছক অনুযায়ী চলছেই না।
জীবনের এইসব সংগ্রামে আপনি ক্লান্ত হতে পারেন মাঝে মাঝে, তবে হতোদ্যম হবেন না। বিচ্ছেদ-ব্যথায় আপনি কাঁদতেও পারেন, যেভাবে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জ্যোতি হারিয়েছিলেন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। কাঁদুন, অশ্রু ঝরান, ব্যাকুল হোন; কিন্তু কখনোই আল্লাহকে অভিযুক্ত করবেন না। ধৈর্য রাখুন। আপনার জীবনের যে অংশটা এখনো বাকি, যে অংশে আপনার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে, তা আপনি জানেন না–তার জন্য আল্লাহকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না।