একইভাবে ওই বালক হত্যার মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তার বাবা-মাকে ভবিষ্যৎ বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। খাবার চেয়ে তিরস্কৃত হওয়ার পরেও ভগ্নপ্রায় দেওয়াল বিনা পারিশ্রমিকে মেরামত করিয়ে দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দুই ইয়াতিম শিশুর সম্পদকে সুরক্ষিত করে রাখলেন।
এসব-ই আল্লাহর পরিকল্পনার অংশ। ভূত ও ভবিষ্যৎ কেবল আল্লাহই জানেন, আমরা জানি না। আর জানি না বলেই আমরা খুব সহজেই বিচলিত হয়ে পড়ি। আপাত ক্ষতিতে, আপাত বিচ্ছেদে, আপাত বিরহে আমরা ভেঙে খান খান হয়ে যাই।
যদি আমি আল্লাহর কাছে সৎ থাকি, যদি আমি এই ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হতে পারি যে, কোনো অন্যায় আমি করিনি; তাহলে আমার কোনোভাবেই উচিত নয় তাকদিরের ফয়সালার ওপর অসন্তুষ্ট হওয়া। কোনোভাবেই আল্লাহর পরিকল্পনাকে। দোষারোপ করা আমার কাজ হতে পারে না।
ডিভোর্সের বেলায়, যদি আপনি সৎ থাকেন আপনার সঙ্গীর ব্যাপারে, তার অধিকারের ব্যাপারে যদি আপনার দিক থেকে কোনো অন্যায় না হয়ে থাকে, আপনার সততা, ভালোবাসা, মায়া এবং যাবতীয় আত্মিক সম্পর্কের নিয়ামকগুলো বহাল থাকা সত্ত্বেও যদি আপনার সংসার ভেঙে যায়, যদি আপনার জীবনসঙ্গী আপনাকে অপছন্দ করে ছেড়ে চলে যেতে চায়–তাহলে তাকে যেতে দিন। আল্লাহ হয়তো-বা আপনার জন্য ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা এঁকেছেন, যা আপনি এই মুহূর্তে বসে দেখতে পাচ্ছেন না। হয়তো আরো যোগ্য কেউ, আরো ভালো, আরো চক্ষু শীতলকারী কোনো জীবনসাথি আপনার জন্য তিনি নির্ধারণ করেছেন, যার কাছে যেতে হলে আপনাকে এই সম্পর্ক থেকে বেরোতে হবে। তিনি আপনাকে একটা জঞ্জাল থেকে মুক্ত করে, একটা নির্মল পরিবেশ দিতে চান। সেই নির্মল, নির্ঞ্ঝাট পরিবেশে যেতে আপনাকে একটা দুঃখের নদী পার হতে হবে। এই বিচ্ছেদ-ব্যথা হলো সেই দুঃখের নদী। সেটা পার হন, তবে আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ কৃতজ্ঞচিত্তে।
সেই মাঝি জানতো না, তার জন্য কী অপেক্ষা করে ছিলো সমুদ্রে; সেই বালকের বাবা-মা জানতো না, ভবিষ্যতে কোন দুর্ভোগ তাদের জন্য ওত পেতে আছে; সেই ইয়াতিম শিশুগুলো জানতো না, তাদের জন্য কী সম্পদ লুকায়িত আছে দেয়ালের নিচে। কেউ-ই কিছু জানতো না। না জানার কারণে বিচলিত হয়ে পড়াটা মানুষের বৈশিষ্ট্য; তবে এমন দুঃখের দিনে, এমন দুর্ভোগ আর দুর্দিনে যদি আল্লাহর পরিকল্পনাকে ভালোবেসে ফেলা যায়, নিজেকে সেই পরিকল্পনার অংশ মনে করা যায়, তাহলে অন্তর থেকে বিদেয় দেওয়া যায় যাবতীয় দুঃশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনাগুলোকে।
তিন.
জীবনে যা কিছু ঘটে, তার পেছনে আল্লাহর একটা পরিকল্পনা থাকে। কোনো মুমিন বান্দার জীবনে যখন কোনো দুর্যোগ নেমে আসে, যখন কোনো বিপদ এসে লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় তার জীবনের সাজানো উঠোন, তখন হতবিহ্বল না হয়ে সেই
পরিকল্পনায় নিজেকে সঁপে দেওয়ার মাঝেই প্রভূত কল্যাণ নিহিত।
ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যখন শিশু ইসমাইল আলাইহিস সালামসহ হাজেরা আলাইহাস সালামকে জনমানবহীন মক্কার রুক্ষ এক উপত্যকায় রেখে যান, সেই দৃশ্যের কথা ভাবলে মনে হয়, একজন নারীর জীবনে এর চাইতে বেদনাবিধুর মুহূর্ত আর থাকতেই পারে না। এমন নির্জন সে প্রান্তরদৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো মানবকুলের আভাস পর্যন্ত পাওয়া যায় না। খাবারের বন্দোবস্ত নেই, পানির বন্দোবস্ত নেই। এমনকি একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত ছিলো না সেখানে। হাজেরা আলাইহাস সালামের জন্য তার ওপর আরো কঠিন বিয়োগ-ব্যথা ছিলো–ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কাছ থেকে দূরে থাকা। এই যে এত আসন্ন বিরহ ও বিপদ, সম্মুখে এত রুক্ষ-কঠিন দিনের চোখ রাঙানি–সমস্তকিছু জেনেও সেদিন হাজেরা আলাইহাস সালাম কান্নায়, দুঃখে, রাগে ফেটে পড়েননি। ভীষণ হতাশায় আর্ত-চিৎকার করে তিনি জানতে চাননি, ‘কেন আমার সাথেই এমন হচ্ছে? কী দোষ আমি করেছি? বরং তিনি ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কাছে জানতে চাইলেন, আপনি যা করতে যাচ্ছেন, তা কি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নির্দেশ?’
ইবরাহিম আলাইহিস সালাম বললেন, হ্যাঁ।
হাজেরা আলাইহাস সালাম তখন বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয় আমার রব আমাকে তার দয়া থেকে বঞ্চিত করবেন না।’[2]
কোলের শিশুকে নিয়ে হাজেরা আলাইহাস সালাম সেই একাকী রুক্ষ নির্জন প্রান্তরে থাকতে রাজি হয়ে গেলেন শুধু এইটুকু আশ্বাস পেয়ে, এই কাজের নির্দেশ ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছ থেকেই পেয়েছেন। এমন ভাগ্যকে বরণ করে। নিতে আর কোনো আশ্বাসবাণী, আর কোনো সান্ত্বনাবাক্য হাজেরা আলাইহাস সালামের দরকার পড়েনি। কারণ তিনি জানতেন, আল্লাহর কোনো এক পরিকল্পনার মধ্যে তিনি যুক্ত হতে চলেছেন এবং সেই পরিকল্পনায় তার জন্য এমনকিছু অপেক্ষা করে আছে, যা কল্পনার চেয়েও সুন্দর, স্বপ্নের চাইতেও অবিশ্বাস্য! যেহেতু এই পরিকল্পনাকারী স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা-ই, তাই এই পরিকল্পনায়। অখুশি হওয়ার, অতৃপ্তি মনে পুষে রাখার এবং এই পরিকল্পনায় অসম্মতি জ্ঞাপনের কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না।
হাজেরা আলাইহাস সালামের বিশ্বাস অমূলক ছিলো না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার এক মহা-পরিকল্পনার মধ্যে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন সেদিন। হাজেরা আলাইহাস সালামের সেদিনকার সেই কষ্টের দিনগুলোর বিনিময়ে, সেই রুক্ষ-কঠিন একাকী নির্জন প্রান্তরের নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোর বদৌলতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে এমনভাবে স্মরণীয় করে রাখলেন যে, কিয়ামত অবধি যতজন মুসলিম হজ আর উমরা সম্পন্ন করবে, তাদেরকে অতি-অবশ্যই হাজেরা আলাইহাস সালামের স্মৃতিকে স্মরণ করতে হবে। তার স্মৃতি স্মরণ করে সাফা-মারওয়ায় দোঁড়াতে হবে। আর ইসমাইল আলাইহিস সালামের স্মৃতিবিজড়িত যমযম কূপ তো ইতিহাস-ই হয়ে থাকলো!