দুই.
সুরা কাহফে আমরা খিযির আলাইহিস সালামের সাথে মুসা আলাইহিস সালামের সাক্ষাতের যে বিবরণ দেখতে পাই, তাতে বিস্ময়কর একটা ঘটনা আছে। মুসা আলাইহিস সালাম এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, খিযির আলাইহিস সালামের সমস্ত কর্মকাণ্ড তিনি ধৈর্য ধরে অবলোকন করবেন ও শিখবেন।
খিযির আলাইহিস সালাম মুসা আলাইহিস সালামকে নিয়ে একটা নৌকায় চড়লেন। নৌকা থেকে নামার আগে ওই নৌকায় তিনি একটা ফুটো করে দেন। এটা দেখে বিস্মিত হয়ে পড়েন মুসা আলাইহিস সালাম। বললেন, ‘আপনি এই কাজ কেন করলেন? এটা তো ঠিক করলেন না।’
খিযির আলাইহিস সালাম বললেন, ‘কথা ছিলো আপনি আমার সমস্ত কাজ ধৈর্য ধরে দেখবেন। আমি না বলা পর্যন্ত কিছু বলতে পারবেন না।’
নিজের প্রতিজ্ঞার কথা ভেবে লজ্জিত হন মুসা আলাইহিস সালাম এবং তিনি খিযির আলাইহিস সালামের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।
এরপর লোকালয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা বালক তাদের সামনে এসে পড়ে। খিযির আলাইহিস সালাম এবার করে বসেন আরো আশ্চর্যজনক কাজ! মুসা আলাইহিস সালামের সামনেই তিনি বালকটিকে হত্যা করে ফেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে যান মুসা আলাইহিস সালাম! তিনি অধৈর্য হয়ে বলেন, ‘হায়! হায়! এটা আপনি কী করলেন? এই নিরীহ শিশুটাকে আপনি মেরে ফেললেন? এটা কি আপনি ঠিক কাজ করলেন?
খিযির আলাইহিস সালাম বললেন, ‘আপনি কিন্তু আবারও ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছেন।’
পুনরায় লজ্জিত ও অনুতপ্ত হলেন মুসা আলাইহিস সালাম।
এরপর চলতে চলতে তারা একটা বাড়ির কাছে এসে ওই বাড়ির লোকেদের কাছে কিছু খাবার চাইলেন; কিন্তু বাড়ির লোকেরা তাদেরকে কিছু খেতে দিলো না। ওই বাড়ির পাশে একটা ভগ্নপ্রায় দেওয়াল ছিলো, যা অতি-দ্রুতই ভেঙে পড়বে। খিযির আলাইহিস সালাম ওই দেওয়াল নিজ হাতে মেরামত করে দিয়ে রওনা করলেন নিজের পথে। এবারও অবাক হলেন মুসা আলাইহিস সালাম! ভাবলেন, ‘আরে! এরা তো আমাদের কিছু খেতেও দিলো না, তথাপি ইনি তাদের দেওয়ালটা মেরামত করে দিলেন কেন? আচ্ছা, তা নাহয় দিলেন, কিন্তু এর বিনিময়ে তো কিছু পারিশ্রমিক তিনি চাইতে পারতেন তাদের কাছে, যা দিয়ে আমরা কিছু কিনে খেতে পারতাম?’
মুসা আলাইহিস সালাম বললেন, আপনি তো চাইলে এই কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিতে পারতেন।
এবার খিযির আলাইহিস সালাম বললেন, আপনার সাথে আমার যাত্রা এখানেই সমাপ্ত। ধৈর্য ধরে রাখার শর্তারোপ থাকা সত্ত্বেও আপনি বারে বারে ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছেন; তবে যে তিনটি ঘটনা আপনি দেখেছেন, তার ব্যাখ্যা আমি আপনাকে বলবো।
আপনি দেখেছেন, একটা নৌকায় আমি ফুটো করে দিয়েছিলাম। তা এজন্যই যে সমুদ্রে, কিছুটা দূরেই এক রাজা জেলেদের যা নৌকা পাচ্ছে, সব অন্যায়ভাবে জব্দ করে নিচ্ছে। আমরা যে গরিব মাঝির নৌকায় চড়েছি, ফুটো করে দেওয়ার ফলে তা বেশিদূর এগোতে পারবে না। যেভাবেই হোক–সে নৌকাটাকে কূলে ভিড়াবে। ফলে ওই লোভী রাজার হাতে জব্দ হওয়া থেকে বেঁচে যাবে দরিদ্র মাঝির নৌকাটা।
দ্বিতীয়বার আপনি দেখেছেন, আমি একটা বালককে হত্যা করেছি। তা এজন্যই যে–ওই বালক বড় হলে আল্লাহর অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘনকারী হয়ে যেতো, কিন্তু তার বাবা-মা আল্লাহর খুবই একনিষ্ঠ বান্দা। ওই সন্তানের কারণে তার পিতা-মাতাকে ভবিষ্যতে অনেক যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো। ফলে আমি ওই বালককে হত্যা করি এবং আমি এ-ও আশা করি, তার বিনিময়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদের নেককার সন্তানাদি দান করবেন।
তৃতীয় এবং সর্বশেষ যে ঘটনাটা আপনি দেখেছেন, তা হচ্ছে–আমি কিছু অকৃতজ্ঞ মানুষদের ভগ্নপ্রায় দেওয়াল বিনা পারিশ্রমিকে মেরামত করে দিয়েছি। তা এজন্যই–ওই দেওয়ালটা ছিলো শহরের দুই ইয়াতিম শিশুর। দেওয়ালের নিচে তাদের বাবার রেখে যাওয়া কিছু লুকানো সম্পদ আছে। দেওয়ালটা যদি এখনই সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যায়, তাহলে গুপ্ত সম্পদগুলো প্রকাশ্যে চলে আসবে এবং ওই
অন্য লোকেরা তা আত্মসাৎ করে ছাড়বে। ছোটো শিশু দুটোর তাতে কিছুই করার থাকবে না তখন। যেহেতু আমি দেওয়ালটা মেরামত করে দিয়েছি, শিশুগুলো বড় হওয়ার আগে সেটা ভেঙে পড়ার কোনো সম্ভাবনা অবশিষ্ট নেই। আর তারা বড় হওয়ার পরে যখন সেটা ভাঙবে, তত দিনে নিজেদের সম্পদ বুঝে নেওয়ার বয়স। তাদের হয়ে যাবে।[1]
এই ঘটনা তিনটাতে আমরা দেখতে পাই–খিযির আলাইহিস সালামের সাথে ধৈর্য ধরে রাখার শর্তে আবদ্ধ থাকার পরও মুসা আলাইহিস সালাম বারংবার নিজের ওয়াদা থেকে বিচ্যুত হচ্ছিলেন। এর কারণ হলো–মুসা আলাইহিস সালাম তাকদির সম্পর্কে জ্ঞাত নন। আল্লাহ তাকে সেই জ্ঞান প্রদান করেননি, যা তিনি খিযির আলাইহিস সালামকে দিয়েছিলেন। ফলে একই বিষয়ে মুসা আলাইহিস সালাম বিচলিত, বিমূঢ় ও বিভ্রান্ত হলেও খিযির আলাইহিস সালাম ছিলেন শান্ত ও স্থির।
খিযির আলাইহিস সালাম আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানে জানতে পেরেছিলেন এক অসাধু রাজার ব্যাপারে, যে দরিদ্র মাঝিদের নৌকা জব্দ করছে। এক মাঝিকে সেই অসাধু রাজার অন্যায় কাজ থেকে বাঁচাতে তিনি মাঝির নৌকায় ফুটো করে দেন যাতে নৌকাটা আর বেশিদূর না এগোতে পারে। নৌকার মাঝির কাছে এবং মুসা। আলাইহিস সালামের চোখে খিযির আলাইহিস সালামের এই কাজ ভারি অন্যায়ের। এই কাজের ভবিষ্যৎ ফলাফল জানতেন না বলেই তারা এমনভাবে বিচলিত হয়ে পড়েছেন, কিন্তু তাকদির তথা আল্লাহর কৌশল ভিন্ন। তিনি আপাত ক্ষুদ্র ক্ষতি দিয়ে ওই দরিদ্র মাঝিটাকে বৃহৎ ক্ষতির রাস্তা থেকে বাঁচিয়ে দিলেন।