এখানেও মায়ের মনে এল না, নরেন রাগ করবে কিনা, অথবা নরেন আমার কথা রাখবে কিনা?
এমন সহজ নিশ্চিন্ত আসে শুধু ভালবাসার অসীম ক্ষমতা থেকে।
আজকের যুগ ভালবাসার সঞ্চয়ে ক্রমশই যেন দেউলে হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে ফেলছে ভালবাসবার ক্ষমতা। আজকে যেন কেউ কারও অন্তরঙ্গ নয়, সবাই নিঃসঙ্গ।
এ যুগের বহুবিধ সমস্যার মধ্যে এইটিই বোধহয় সব থেকে বড় সমস্যা, এই ভালবাসাহীনতা! এ সমস্যা যুগকে রুক্ষ শুষ্ক করে ফেলছে। ধ্বংস করে ফেলতে চাইছে মানুষের মধ্যেকার মানবিকতা-বোধ পর্যন্ত। মনে হয়–এখনই বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষণ এসেছে অগাধ ভালবাসার সঞ্চয়ে ভরা শ্ৰীমার জীবন ও বাণীর অনুধ্যানের।
এমন সহজ সাধনা আর কোথায় মিলবে? কোথায় মিলবে এমন আটপৌরে ঈশ্বরী?
ভক্ত আর ভগবানের মধ্যে দূরত্ব ঘোচাবার বড় সহজ কৌশলটি আবিষ্কার করেছিলেন মা সারদা। কোথাও কোন ব্যবধান নেই, জগতে শুধু মা আছেন আর সন্তান আছে। জাগতিক সম্পর্কগুলিও ক্রমশ তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে, সবাই ডাকছে মা! সবাই বলছে মা!
মায়ের কাছে জাতিভেদের বিন্যাস আলাদা। তার কাছে ভক্ত একটি বিশেষ জাত। আর সেটি খুব উঁচু জাত। ভক্তরা আসবে, ভক্তরা খাবে, ভক্তদের কষ্ট হচ্ছে, এ নিয়ে তার ব্যস্ততার শেষ নেই। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে ভক্তদের এঁটো পরিষ্কার করতেও দ্বিধা ছিল না তার। সে যেন ভক্তদের প্রতি ভক্তিরই প্রকাশ। কিন্তু আচার-পরায়ণা নলিনীদি বলতেন, মাগো, ছত্রিশ জাতের এঁটো কুড়াচ্ছে!
মায়ের অনায়াস উত্তর, সব যে আমার, ছত্রিশ কোথা?
হ্যাঁ সবই তার। ভক্ত তো বটেই, অবোধ-অজ্ঞানও।
মাঝে মাঝে মা খবরের কাগজ পাঠ শুনতেন। তখন স্বাধীনতা-আন্দোলনের কাল। রাজনৈতিক নির্যাতন, বিশেষ করে মেয়েদের ওপর অত্যাচার শুনলে ঠাকুরের ছবির কাছে গিয়ে ক্ষুব্ধভাবে বলতেন, এসব কি হচ্ছে!
অথচ কেউ ইংরেজের সম্পর্কে ঘৃণা প্রকাশ করলে বলতেন? তারাও তো আমার ছেলে।
তাঁর বাণীই তাঁর জীবন।
মালাছেঁড়া মুক্তোর মত অজস্র অমূল্য বাণী ছড়ানো রয়েছে শ্রীমার নিত্যদিনের প্রতিটি সহজ কথার মধ্যে–যে-বাণীর অন্তর্নিহিত তত্ত্ব তার আপন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে মূর্ত হয়ে প্রকাশিত।
নারী-পুরুষ, গৃহস্থ সন্ন্যাসী, সকলের জন্যই ছিল তাঁর পথনির্দেশের শিক্ষাবাণী। সহজ সাধারণ ঘরোয়া কথার মধ্যে জীবননীতির কী অসাধারণ মন্ত্রগুলিই রেখে দিয়েছেন তিনি! গ্রহণেচ্ছু মন নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখলে অনেক কিছুই পাওয়া যায়।
মায়ের হিসাবে, জ্ঞানী সন্ন্যাসী যেন হাতীর দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো। কিন্তু সন্ন্যাসীর রাগ অভিমান? সে যেন বেতের রেক চামড়া দিয়ে বাঁধা।
অনেক সন্ন্যাসী-সন্তানের রাগ-অভিমানের ধাক্কা মাকে সইতে হয়েছে সন্দেহ নেই। সেদিক থেকে তুলনাটি তাৎপর্যপূর্ণ। তবে মা সেই রাগ-অভিমানের সম্মানও রাখতেন বইকি! মা সকলেরই সম্মান রাখতেন, রাখতে শেখাতেন।
কেউ উঠোন পরিষ্কার করে ঝাঁটাটা ছুঁড়ে ফেলে রাখছে দেখে বলে উঠলেন : ও কি গো… যার যা মান্যি, তাকে সেটি দিতে হয়। বঁটাটিকেও মান্যি করে রাখতে হয়…।
বলতেন, সময়ে ছাগলের পায়েও ফুল দিতে হয়।
বলতেন, স্ত্রীলোকের লজ্জাই হল ভূষণ। যার আছে ভয়, তারই হয় জয়। যে সয় সেই রয়।
আমাদের জীবনে আর কর্মে এই ছোট্ট ছোট্ট উপদেশগুলি যদি গ্রহণ করতে পারা যেত অনেক সমস্যার সহজ সমাধান হয়ে যেত।
পৃথিবীর মত সহ্যশীলা মা-সারদা, পৃথিবীর মানুষকেও উপদেশ দিয়ে রেখেছেন, পৃথিবীর মতো সহ্যগুণ চাই। পৃথিবীর ওপর কত রকমের অত্যাচার হচ্ছে, অবাধে সব সইছে।১৫ সন্তোষের সমান ধন নেই। আর সহ্যের সমান গুণ নেই।
মানুষ শান্তি শান্তি করে পাগল হয়, কিন্তু নিজেই অশান্তি সৃষ্টি করে। মা এই অবস্থা থেকে উদ্ধার হবার একটি সহজ পথ বাতলে দিয়েছেন, যদি শান্তি চাও, মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের।১৭
সকলের ওপর সমান ভালবাসা হয় কি করে জানো? যাকে ভালবাসবে তার কাছে প্রতিদান কিছু চাইবে না। তবেই সকলের ওপর সমান ভালবাসা হয়।
অধিকারী-অনধিকারী নির্বিশেষে সব ভক্তদের সর্বদা একই আক্ষেপ, ভগবান পেলাম না, ভগবান পেলাম না। তার উত্তরে মা বলেছেন, ভগবানলাভ হলে কি আর হয়? দুটো কি শিং বেরোয়? না, মন শুদ্ধ হয়? শুদ্ধ মনে জ্ঞানচৈতন্যলাভ হয়।
নির্বাসনা মা বলেছেন, বাসনাই সকল দুঃখের মূল। ঠাকুরের কাছে যদি কিছু চাইতেই হয়, তো-নির্বাসনা চেয়ে নেবে।
অথচ নিজেই রাধুর অসুখে দেবতার উদ্দেশে পয়সা তুলে রাখছেন। দেখে কোন ভক্ত-মহিলা বলছেন, মা, আপনি কেন এরূপ করছেন? মায়ের তৎক্ষণাৎ মীমাংসা, অসুখ হলে ঠাকুরদের মানত করলে বিপদ কেটে যায়, আর যার যা প্রাপ্য তাকে তা দিতে হয়।
গৃহদেবতা, কুলদেবতা, গ্রামদেবতা সকলেরই যে কিছু প্রাপ্য থাকে, এইটিই উল্লেখ করে বোঝালেন।
সকল সমস্যা আর সকল সংশয়ের মীমাংসা তাঁর কাছে।
যেখানে যেমন সেখানে তেমন, যখন যেমন তখন তেমন।
জলে ইচ্ছে করেই পড় আর কেউ ঠেলেই ফেলে দিক-কাপড় ভিজবেই। জোর করে জপের অভ্যাস করলেও, জপমন্ত্রের কাজটি হবেই কিছু।
এমন কত কথাই অহরহ বলে গেছেন মা উঠতে, বসতে, চলতে, ফিরতে।
জগতে মহৎ আদর্শের অভাব নেই, নেই মহৎ বাণীর অভাব। অভাব শুধু গ্রহণেচ্ছু চিত্তের!