- বইয়ের নামঃ কথামৃতের কথায়
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
কথামৃতের কথায়
মনে হয়েছিল, এ আর এমন কি! এতবার পড়া, এমন আকর্ষণীয় প্রিয় গ্রন্থ কথামৃত, তার সম্পর্কে কিছু একটু লিখে ফেলা, এই তো? খুবই তো সহজ, দুদিনেই হয়ে যাবে।
কিন্তু দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে, হচ্ছে না। লিখতে গিয়ে দেখছি, যা নেহাৎ সহজ ভেবেছিলাম, তা মোটেই সহজ নয়। শক্ত করে তুলেছে নিজের মধ্যেই হঠাৎ জেগে-ওঠা প্রশ্নের কাটা।
কথামৃত আমার কাছে একটি আকর্ষণীয় প্রিয় গ্রন্থ–এ কথা বলা কি আমার পক্ষে ধৃষ্টতা নয়? আমি কি একথা বলবার অধিকারী?
আমি কি কখনও ঈশ্বরচিন্তায় ব্যাকুলতা অনুভব করেছি? জিজ্ঞাসু হৃদয় নিয়ে, ঈশ্বরের স্বরূপ জানবার চেষ্টা করেছি, আর কথামৃতের অমৃতধারার মধ্যে তার সমাধান খুঁজে পেয়ে কৃতার্থবোধ করেছি?
কাকে বলে নিশ্চলাভক্তি, কাকে বলে শুদ্ধাভক্তি, আর কেমন করে তা আসে, তা বোঝবার জন্যে অন্তরের মধ্যে কোনও প্রেরণা পেয়েছি? অথবা ওই অমৃতবাণীর সাগরের মধ্যে আমাদের এই অতি সাধারণ গৃহীজীবনের জন্যে সহজ সরল ভাষায় সর্বশাস্ত্র মন্থন করা যে-অনন্ত উপদেশরাশি বিধৃত রয়েছে, সে উপদেশের অনুসরণ করবার সামান্যতম সাধনা করেছি? সেই শিক্ষায় জীবনকে গড়ে তোলবার মানসে মনকে নির্মল, চিত্তকে অহমিকা, অসূয়াশূন্য করে তোলবার ইচ্ছেটুকুও মাত্র কখনও পোষণ করেছি?
কোনও প্রশ্নেরই তো অনুকূল উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। কথামৃতে বহমান রসধারা তো এই দীর্ঘজীবনের শুকনো মাঠে-মাঠেই মারা গেছে। কিছুই তো গ্রহণ করতে পারি নি।
তবে? তবে কেন প্রিয়? কেন ভাল লাগে?
তবে কি কথামৃতের মধ্যে যে-পরম সাহিত্যমূল্য রয়েছে, সেই বস্তুটিই আমায় বরাবর আকৃষ্ট করে এসেছে?
কথামৃতের ছত্রে-ছত্রে যে-গভীর জীবনবোধের প্রকাশ, উপলব্ধির যে-ব্যঞ্জনাময় সঙ্কেত, উদার জীবনদর্শনের যে সীমাহীন বিস্তার, অতুলনীয় তুলনাপ্রয়োগকৌশল, আর ছোট-ছোট গল্পকাহিনী পরিবেশনার মাধ্যমে বৈচিত্র্যময় মানবচরিত্রের যে-নিপুণ বিশ্লেষণ এবং তার সঙ্গে সরস বাকবৈদগ্ধ্য, সূক্ষ্ম প্রসাদগুণ–তা অবশ্যই উচ্চমানের সাহিত্যের দাবি রাখে। সর্বোপরি বিশ্বাসের সততা চিরায়ত সাহিত্যের মূলধন।
আপন হৃদয়সত্যকে অপরের হৃদয়ে সঞ্চারিত করতে পারার শক্তি, আপন বিশ্বাসকে অপরের বিশ্বাসের ভূমিতে স্থাপন করার দৃঢ়তা, জীবসত্তার মধ্যে শিবসত্তার উন্মোচন, এইগুলিই তো মহৎ সাহিত্যের লক্ষণ, কথামৃত গ্রন্থে এইসব গুণগুলিই তো বর্তমান।
সেই সাহিত্যই স্রষ্টাকে অমরত্ব দান করে, যে-সাহিত্য পৃথিবীকে ভালবাসতে শেখায়। কথামৃতের মধ্যে তো সেই অফুরন্ত ভালবাসার শিক্ষা।
মনে হয়, আজ ঘরে-ঘরে গীতার মত নিত্যপাঠ্য এই অমূল্য গ্রন্থখানি ভবিষ্যকালের মূল্যায়নের কষ্টিপাথরে কেবলমাত্র মানবজীবনের পরমার্থ-নিদের্শক গ্রন্থ হিসেবেই নয়, চিরায়ত সাহিত্যগ্রন্থ হিসেবেও মূল্যায়িত হবে।
কথামৃতের শতবার্ষিকী সহস্র-সহস্র বৎসরের সূচনা মাত্র। বুদ্ধের বাণী, খৃষ্টের বাণী তো আজও অম্লান। কথামৃত হাজার-হাজার বছর ধরে মানবজীবনকে আশ্রয় দেবে।
তবু বলব, কথামৃত–এই গুণগুলি ব্যতীতও আমার কাছে আরও কিছু, অধিক কিছু। কথামৃত দুঃখের দিনে, বেদনার দিনে, অস্থিরতার ক্ষণে, যেন একটি শান্ত সান্ত্বনা এনে দেয়। যেন মনের জন্যে মানসিক একটি আশ্রয় মজুত আছে, প্রয়োজনের সময় সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেই হল।
অথবা শুধুই কথামৃত নয়, শ্রীশ্রীমা সারদামণির আর শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণের পুণ্যজীবনী এই গ্রন্থের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অখণ্ড একটি আশ্রয়।
তবু এও জানি, একথা বলার যোগ্যতা আমার নেই। ভালো লাগে, শান্তি পাই, চাঞ্চল্যও দূর হয়, কিন্তু নির্দেশ-উপদেশগুলি গ্রহণ করতে পারি কই?
স্মৃতি হাতড়ালে–
কথামৃতের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় অতি বাল্যে। আমার বইপাগল মার সংগ্রহভাণ্ডারে ছিল তঙ্কালীন বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের যত গ্রন্থাবলী। এবং বহুবিধ পত্রপত্রিকা। চালু-অচালু প্রায় সব। তবে মনে হয়, মলাটছেঁড়া বড়মাপের কোনও পুরনো পত্রিকার মধ্যে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে লেখা এই কথামৃত কিছু কিছু পড়ে থাকব। কারও মেয়েও তো মায়ের মতই পড়াপাগল। (স্কুল পাঠশালার বালাই তো ছিল না। অখণ্ড অবসরের সুযোগ পাই তাই পড়া চলে। এমন কি মুদি-মশলার দোকানের ঠোঙাতেও যদি বাংলা হরফে কিছু ছাপা লেখা থাকে তো, ঠোঙাটিকে সাধধানে খুলে নিয়ে পড়ে ফেলে।)
একথা বলব না যে, সেই পত্রিকার (কোন পত্রিকা মনে নেই) পৃষ্ঠায় পড়ার সময় বিশেষ আকৃষ্ট হয়েছিলাম। পড়েছি এইটুকু মনে আছে। যা পাই তাই পড়ি তো।
অতঃপর একসময় কথামৃত আস্ত একটি গ্রন্থ পড়ার সুযোগ হল, শ্বশুরবাড়িতে এক প্রতিবেশিনী মহিলার মাধ্যমে। যদিও তখন সেকালের নিয়মে নতুন বৌকে গুরুজনস্থানীয়া মহিলাদের সামনেও ঘোমটা দিতে হয়, গলার স্বর নামিয়ে কথা বলতে হয়, তবু তিনি একদা দুপুরে এসে হানা দিলেন দুতিন খানা বই হাতে নিয়ে। বললেন, বৌমা গো, চোখ থাকতে অন্ধ। একটু পড়ে শোনাও, শুনি।
বিয়ের সময়ই জানা হয়ে আছে, এবাড়ির নতুন বৌয়ের স্বরচিত,লেখা নাকি বইকাগজে ছাপা হয়, অতএব সে তো রীতিমত চক্ষুষ্মন। কাজেই চক্ষুম্মান বৌকে নিজের পাঠযোগ্য বইটই রেখে দিয়ে সারা দুপুর পাঠের আসর খুলতে হয়। তবে একটা মস্ত লাভ হয়, ফাঁকতালে বৌয়ের ঘোমটা কমে এবং গলার স্বর ওঠে। কারণ সে আসরে গুটিগুটি অনেকগুলি মহিলারই সমাবেশ হয়, তাঁরাই উদারকণ্ঠে আদেশ দেন, আর একটু জোরে পড়ো বৌমা। যতদূর মনে পড়ে, বইগুলির মধ্যে ছিল বোধহয় দুতিন খণ্ড অমিয় নিমাই চরিত, একখানি কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীর জীবনী, আর একখানি কথামৃত। বোধহয় প্রথম খণ্ডই। মলাট ছেঁড়া, টাইটেলপেজও অন্তর্হিত।নাম দেখেই ছেলেবেলার সেই কিছু খানিকটা পড়ার কথা মনে পড়ে যায়।