আবার এই প্রশ্নটিও তার মনে জেগেছিল, তিনি পুরনো আদর্শের শেষ প্রতিনিধি না নতুন কোন্ আদর্শের অগ্রদূত?
দেখা যায়, শ্রীমা একাধারে এই দুই আদর্শেরই ধারক। তার মধ্যে একদিকে যেমন কর্মে, ধর্মে, আচারে-আচরণে, জীবনদর্শনের ভঙ্গিতে, ভারতীয় নারীর শাশ্বত ভাবধারাটি পরিস্ফুট, অপরদিকে তেমনই সংস্কারমুক্ত চিত্তের উদার আলোকের স্ফুরণ।
এই সংস্কারমুক্ত চেতনার প্রতিবিম্বটি বিশেষ করে স্পষ্ট ধরা পড়েছে নিবেদিতার ক্ষেত্রে। বিদেশিনী মেয়ে নিবেদিতা মায়ের পরমপ্রিয় খুকি। প্রথম দর্শনেই মা তাকে কোলে টেনে নিয়েছেন। কাছে বসিয়ে আদর করেছেন, নিজের বিছানায় বসিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়েছেন, হাতে করে খাইয়েছেন, এমন কি একসঙ্গে খেয়েছেন।
নিবেদিতার যে কর্মর্জগৎ, মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো, সমাজে মেয়েদের অবস্থার উন্নতিসাধন, এগুলিতে যে মায়ের পরম উৎসাহ! তাই নিবেদিতা তার একান্ত আপনজন।
আজকের দিনের কথা ছাড়তে হবে, সেকালের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে বোঝা যায়, কী প্রচণ্ড একটি বিপ্লবী কাজ করেছেন মা নিঃশব্দে, নিরাড়ম্বরে। তাঁর কাছে কেউ বিদেশী নয়, কেউ দূরের নয়, কারণ তিনি মা! সবাইয়ের মা! তিনি পতিতেরও মা।
কখনও কোনও বহিরাগত ভক্তের কোন অসঙ্গত আচরণ দেখে ঠাকুরের অন্তরঙ্গ ভক্তদের কেউ যদি মাকে অনুরোধ করেছেন সেই লোককে কাছে আসতে না দিতে, মা বলে উঠেছেন, অমন কথা আমার মুখ দিয়ে বেরুবে না। আমার ছেলে যদি ধুলোকাদা মাখে, আমাকেই তো ধুলো ঝেড়ে কোলে নিতে হবে!
জয়রামবাটীতে এত পুঁতে মুসলমান কিছু কলা নিয়ে এসেছে ঠাকুরের জন্য। বলছে, মা… নেবেন কি?
মা হাত পেতে বলেছেন, খুব নেব, বাবা, দাও। ঠাকুরের জন্য এনেছ, নেব বই কি?
কেউ যখন বললেন, ওরা চোর, আমরা জানি। ওর জিনিস ঠাকুরকে দেওয়া কেন? সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয় না মায়ের। মুসলমানটি মুড়ি-মিষ্টি নিয়ে বিদায় নিলে মা গম্ভীরভাবে বলে ওঠেন, কে ভাল, কে মন্দ, আমি জানি। তিনি বলতেন, দোষ তো মানুষের লেগেই আছে। কি করে যে তাকে ভাল করতে হবে, তা জানে কজনে।
কেমন করে মন্দকে ভাল করতে হয়, এই জানাটিই তো আসল জানা। মা কত অপরাধীকে, কত পতিতকে ক্ষমার মন্ত্রে আর বিশ্বাসের মন্ত্রে শুদ্ধ করে তুলেছেন, মায়ের জীবনগ্রন্থে ছত্রে ছত্রে তার দৃষ্টান্ত বিস্তৃত।
মায়ের ডাকাতবাবার কাহিনীটি কার না জানা?
সন্ধ্যার অন্ধকারে একা সারদা মুখোমুখি হলেন সেই ভয়ঙ্কর ডাকাতের সঙ্গে। যে-লোক নাকি অনায়াসে মানুষ খুন করতে পারে।
মা-সারদা ভয়ে সংজ্ঞা হারালেন না, আর্তনাদ করে উঠলেন না, একান্ত বিশ্বাসের নম্রতা নিয়ে তার কাছেই শরণ চাইলেন। বললেন, বাবা, আমার সঙ্গীরা আমাকে ফেলে গেছে, আমি বোধহয় পথ ভুলেছি; তুমি আমাকে সঙ্গে করে যদি তাদের কাছে পৌঁছে দাও! ডাকাতপত্নীর হাত ধরে বললেন, মা, আমি তোমার মেয়ে সারদা, সঙ্গীরা ফেলে যাওয়ায় বিষম বিপদে পড়েছিলুম; ভাগ্যে বাবা ও তুমি এসে পড়লে…।
হঠাৎ ওলট-পালট হয়ে গেল সেই দস্যুদম্পতির হৃদয়। পরবর্তী ঘটনায় এই দেখা যায় যে, আশ্রয়প্রার্থিনীকে তারা যে শুধু আশ্রয়ই দিল, তা নয়, দিল সেবা, যত্ন, শ্রদ্ধা, স্নেহ।
কেমন করে এমন হল? শুধুমাত্র প্রত্যুৎপন্নবুদ্ধির ফলে? তা হয় না। এত সহজ নয়। একান্ত বিশ্বাসের সততাই এমন ঘটনা ঘটাতে পারল। পিতৃ-সম্বোধনের মধ্য দিয়ে মা করাঘাত করলেন তার ঘুমন্ত বিবেকের দরজায়, শরণ চাইলেন তার হৃত মনুষ্যত্বের কাছে।
এ আবেদন ব্যর্থ হল না। দস্যু ফিরে পেল তার হারানো মনুষ্যত্ব, জেগে উঠল তার ঘুমন্ত বিবেক। বিশ্বাসের কাছে পরাজিত হল হিংসা। এই সর্বজন-পরিচিত কাহিনীটির মধ্যে এই শিক্ষাটি রয়েছে–অকপট বিশ্বাসে হিংসাকে জয় করা যায়।
শ্রীমার জীবনের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি কথার মধ্যে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে একটি আশ্চর্য সমন্বয়ের শিক্ষা। তা নইলে বলতে পারেন, আমার শরৎ (স্বামী সারদানন্দ) যেমন ছেলে, এই আমজাদও তেমন ছেলে!
কী অকুতোভয় মহিমান্বিত এই সতেজ উক্তি! কোথায় শরৎ, আর কোথায় দাগী ডাকাত আমজাদ! শরৎ তার একান্ত নির্ভরস্থল, শরৎ তার ভারী। শরৎ সহস্রফণা বাসুকি, যেদিকে জল পড়ে, সেদিকে ছাতি ধরে। শরৎ ছাড়া মায়ের ঝক্কি এমন করে সামলাতে আর কে পারে?
অথচ সাম্যের আদালতে রায় হয়ে গেল, আমার শরৎ যেমন ছেলে, এই আমজাদও তেমন ছেলে। এমন শঙ্কাও মনে এল না, শরৎ একথা শুনলে কি মনে করবে?
না শঙ্কা নেই। যেখানে বিশ্বাস সেখানে শঙ্কার স্থান নেই। আত্মবিশ্বাস থেকেই তো অপরকে বিশ্বাস। তাঁর সন্তানরা কেউ তার উপর বিরক্ত হতে পারে বা রাগ করতে পারে, মা এমন কথা ভাবতেই পারতেন না।
মঠের সেই চোর-ভৃত্যটির কাহিনীই ভাবা যাক।
চুরির অপরাধে স্বামীজী তাকে মঠ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, সে এসে কেঁদে পড়ল মায়ের কাছে। সহানুভূতি-ভরা মাতৃহৃদয় স্থির থাকতে পারল না। বাবুরাম মহারাজকে ডেকে বললেন, দেখ বাবুরাম, এ লোকটি বড় গরীব। অভাবের তাড়নায় ওরকম করেছে। তাই বলে নরেন ওকে গালমন্দ করে তাড়িয়ে দিলে! সংসারের বড় জ্বালা; তোমরা সন্ন্যাসী, তোমরা তো তার কিছু বোঝ না! একে ফিরিয়ে নিয়ে যাও।