আরও স্তব্ধ হতে হয়, আরও ভয়ঙ্কর বিপরীত দুটি ধারাকে এমনই অবলীলায় বহন করার শক্তি দেখে। সাধক-সন্ন্যাসী-স্বামী স্ত্রীকে মা বলে ত্যাগ করেছেন এ দৃষ্টান্ত বিরল নয়, কিন্তু স্ত্রীকে মা বলে গ্রহণ করেছেন, এমন নজির ইতিহাসে আছে?
মা বলে গ্রহণ করলেন, মা কালী বলে ফুল-চন্দনে পূজা করলেন। অথচ চিরকালীন সংস্কারের উপর এই বিপর্যয়, এই আঘাত মা-সারদা অবিচলিত চিত্তে সইলেন, বইলেন।
তারপরও গুণ্ঠনবতী! লোকলোচনের অন্তরালে অবস্থিত সে গুণ্ঠন উন্মোচিত হয়েছে, যখন শতসহস্র ভক্তসন্তান মা মা বলে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
ঠাকুর তার আরব্ধ কর্মভার দিয়ে গিয়েছিলেন লীলাসঙ্গিনী সারদার হাতে। সেই বিপুল কর্ম কী অসাধারণ মহিমায় সমাধা করে গেলেন মা জীবনের বাকি চৌত্রিশটি বছর ধরে। কত শত বিনষ্ট জীবনকে উদ্ধার করলেন, কত শত হাহাকার-পীড়িত হৃদয়কে মাতৃহৃদয়ের আশ্রয় দিলেন, কত শত মেয়েকে দিলেন নারীজীবনের সত্যআদর্শের শিক্ষা।
আর কত ব্যাকুল দীক্ষার্থীকে দিলেন বৈরাগ্যের দীক্ষা, কত ঈশ্বরপিপাসু মনকে দিলেন ঈশ্বর সান্নিধ্যের অনির্বচনীয় স্বাদ। মায়ের নিজের ভাঁড়ারেই তো সে জিনিস মজুত!
ঠাকুরের আবির্ভাব যদি সর্বধর্মসমন্বয়সাধনে, তো শ্রীমার আবির্ভাব সর্বকর্মের সমন্বয়সাধনে। মায়ের জীবনদর্শনে যেমন মানুষের ছোটবড় ভেদ নেই, তেমনই কাজেরও ছোটবড় ভেদ নেই। সবেতেই তাঁর প্রসন্ন প্রশান্তি। ভক্তের পূজার প্রতিমারূপেও তার যেমন অকুণ্ঠ আত্মস্থতা, সংসারের সেবিকারূপেও তেমনই অকুণ্ঠ আত্মস্থতা। যে মুহূর্তে চরণে ভক্তজন-নিবেদিত পুস্পাঞ্জলি নিচ্ছেন, তার পরমুহূর্তেই ছুটছেন সেই ভক্তদেরই আহার-আয়োজনের তদ্বিরে। তাই কি অর্থের স্বচ্ছলতাই আছে? নেই বলেই পরিশ্রম শতগুণ!
জয়রামবাটীর সেই সংসারটিকে ভাবলে যেন মনের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। সে সংসারের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত মধ্যমণিটি দশভুজা হয়ে সংসারটিকে সামলাচ্ছেন। কুটনো কুটছেন, রান্না করছেন, পূজার গোছ করছেন। পূজান্তে প্রসাদ ভাগ করছেন, পান সাজছেন, সুপুরি কাটছেন, আটা-ময়দা মাখছেন, রুটি-লুচি তৈরি করছেন, কলসিতে জল আনছেন, ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছেন, বর্ষার দিনে বাড়ির সকলের ভিজে কাপড় শুকোবার চেষ্টা করছেন, সলতে পাকাচ্ছেন, প্রদীপ সাজাচ্ছেন, লণ্ঠনগুলি পরিষ্কার করছেন, ভক্তদের সমস্ত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করছেন, এমনকি পাড়ায় পাড়ায় বেতো পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছেন–ছেলেদের চায়ের জন্য দুধ যোগাড় করতে।
বাড়িতে যে কাজের লোকের এমনই অভাব ছিল তা নয়, তবুও যে-কোনও কাজই হোক শ্ৰীমা সে-কাজ আর কারও অপেক্ষায় ফেলে রাখতেন না। চোখের সামনের কাজগুলি আর কারও অপেক্ষায় ফেলে না রেখে নিজে করে ফেলা, এই যে শিক্ষাটুকু (শ্রীমার অপার গুণসমুদ্রের এক আঁজলা জল), এইটুকুই যদি আপন অভ্যাসের মধ্যে গ্রহণ করে নিতে পারা যায়, তাহলে সংসারের মানুষ আর মানুষের সংসার ধন্য হয়ে যেতে পারে।
কাজ তুচ্ছই হোক, অথবা বৃহই হোক, তার সম্বন্ধে মূল্যবোধ, আর তাতে নিষ্ঠা, এই তত কর্মশিক্ষার গোড়ার কথা। ঠাকুর শ্রীমাকে বাল্যে প্রদীপের সলতেটি পর্যন্ত কি করে ভালভাবে পাকাতে হয় তা শিখিয়েছিলেন।
শ্রীমার পটভূমিকাটি হচ্ছে শতাধিক বছর আগের বাংলাদেশ। যখন সেখানে জাতপাত আর আর্গের অপ্রতিহত প্রতাপ। এমনকি শহর কলকাতাতেও তার যথেষ্ট দাপট।
নিষ্ঠাবান শিক্ষিত হিন্দু ব্যক্তিরাও অনেকেই সাহেবের অফিসে চাকরি করায়, সারাদিন জলস্পর্শ না করে থাকতেন, বাড়ি ফিরে স্নান করে তবে জল খেতেন। বালিকাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাধ্যসাধনায় মেয়েদের স্কুলে পড়তে দেওয়া হচ্ছে বটে, কিন্তু মেমের ইস্কুলে পড়ার অপরাধে বেচারীদের স্নান করে অথবা গঙ্গাজলে শুদ্ধ হয়ে তবে ঘরে ওঠবার অনুমতি জুটত। অথচ তখন সমাজমানসে ভিতরে ভিতরে উঠেছে এক অস্থির আলোড়ন।
অন্তঃপুরের আড়ালে জাগছে যেন অবরোধমুক্তির পিপাসা, আর বাইরে থেকে চিন্তানায়কদের মধ্যে জাগছে অনড় সমাজের সংস্কারের চিন্তা, তারা ভাবছেন, স্ত্রী-শিক্ষার ও স্ত্রী স্বাধীনতার প্রয়োজন এসেছে, কিন্তু কোনখানে টানা হবে তার সীমারেখা?
ভারতের চিরন্তন ঐতিহ্য তো নষ্ট করা চলে না! সেই চিরন্তন ধারার সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষার ভাবধারা যুক্ত করে অন্ধসংস্কারমুক্ত ভবিষ্যৎ সমাজে মেয়েদের যথার্থ রূপটি কি হওয়া উচিত, এই প্রশ্ন সেই যুগকে বিক্ষত করছে। কোনও কোনও অতি আলোকপ্রাপ্ত জন আলোকপ্রাপ্তির পরিচয় দিতে মেয়েদের গাউন পরিয়ে খোলা গাড়িতে হাওয়া খাওয়াতে পাঠাচ্ছেন, আর বাকি আলোকহীনের দল সেই অভাবিত হাস্যকর দৃশ্যে চকিত হয়ে বেশি করে পুরনো খুঁটি আঁকড়াতে চাইছেন। এমন একটি দিশেহারা সময়ে মা-সারদার আবির্ভাব।
মা-সারদা বহুবিধ মতানৈক্যের সমাধানে একটি ঐক্যের রূপ; সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসানের জন্য একটি দ্বন্দ্বাতীত মাতৃমূর্তি!–যে-মূর্তিটি হচ্ছে ভবিষ্যৎ সমাজের নারীর প্রকৃত রূপের আদর্শ; যে-দ্বন্দ্বাতীত রূপটি দেখে মুগ্ধ হয়ে বিদেশিনী মেয়ে নিবেদিতার মনে হয়েছে, মা-সারদা যেন ভারতীয় নারীর আদর্শ সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণের শেষ বাণী।