- বইয়ের নামঃ লোকশিক্ষায় শ্রীমা
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
লোকশিক্ষায় শ্রীমা
তাঁর জীবনই তাঁর বাণী!
লোকশিক্ষায় শ্রীশ্রীমার অবদানের কথা ভাবতে গেলে প্রথমেই মনে হয় মায়ের আশ্চর্যসুন্দর জীবনখানিই তো একটি সর্বজন-শিক্ষণীয় অনবদ্য পাঠ্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থের ভাষা সরল, শব্দবিন্যাস অনাড়ম্বর, প্রকাশভঙ্গি আকর্ষণীয়, আর বিষয়বস্তু গভীর ব্যঞ্জনাময়।
বহু অধ্যায়ে বিভক্ত, সহজের আবরণে আবৃত এই বিস্ময়কর জীবনগ্রন্থখানির ছত্রে ছত্রে বিধৃত রয়েছে সত্যের শিক্ষা, অধ্যাত্মপথের শিক্ষা, মানবিকতার শিক্ষা, ভালবাসবার শিক্ষা, উদারতার শিক্ষা; ধৈর্যের, সহ্যের, ত্যাগের, ক্ষমার, করুণার, মমতার, আত্মপ্রত্যয়ের, সর্বোপরি সল অবস্থায় অবিচল থাকার শিক্ষা। দুঃখে অবিচল, সুখে অবিচল, প্রাপ্তিতে অবিচল, অপ্রাপ্তিতে অবিচল।
শ্রীমা সারদাদেবীর সমগ্র জীবনখানিতেই অবিচলতার এই আশ্চর্য প্রকাশ। যদিও মনে হয় যিনি গুণাতীতা পরমাপ্রকৃতি বলেই গৃহীত, তার চরিত্রগুণের বর্ণনা করতে যাওয়ার চেষ্টা বাহুল্য-চেষ্টা নয় কি? সাধ্যই বা কতটুকু? তবু–সাধ্য না থাকলেও প্রয়োজন আছে। মাতৃনাম আলোচনায় আমরা ধন্য হই, পবিত্র হই। আর তা থেকে যদি এতটুকুও শুভপ্রেরণা আসে–পরম লাভ।
যুগ বদলায়, সেই বদলের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের চেহারারও বদল ঘটে, চলতি যুগ বিগত যুগের রীতিনীতি, আচার-আচরণ আঁকড়ে বসে থাকতে পারে না, নতুন ভাবধারার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে। যার ফলে প্রায়শই পুরনো আদর্শ, পুরনো চিন্তা-চেতনা, চিরসঞ্চিত সংস্কার ও মূল্যবোধগুলি মূল্য হারায়। কিন্তু মানবিকধর্মের যে মৌল গুণগুলি মানবচরিত্রের চিরন্তন আদর্শ হিসাবে স্বীকৃত হয়ে আসছে, তার কোনও পরিবর্তন হয় কি?
তা তো হয় না। ত্যাগ, ক্ষমা, সততা, সত্যনিষ্ঠা, দৃঢ়তা, মমতা, সাম্যবোধ, মানবপ্রেম, এইসব গুণগুলি চিরন্তন মর্যাদার ভূমিকায় স্থির থাকে।
শ্রীমা সারদাদেবীর অনন্য চরিত্রে এই গুণগুলি পূর্ণমাত্রায় প্রকাশিত ছিল, তাই লোকজীবনে শ্রীমার আদর্শ একান্ত প্রয়োজনীয়ের ভূমিকায় চির-অবিচল থাকবে। সে আদর্শ দেশকালের গণ্ডি অতিক্রম করে যুগে যুগে বিভ্রান্ত মানুষকে পথ দেখাবে, হতাশ জীবনে আশ্বাসের বাণী বহন করে আনবে।
পৃথিবীর একটি পরম প্রয়োজনের মুহূর্তে যুগাবতার ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের ও তাঁর লীলাসঙ্গিনী শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর দিব্য আবির্ভাব।
ঠাকুরের ইচ্ছায় মা-সারদা তাঁর দিব্যসত্তাটিকে লোকচক্ষে আবৃত রাখতে যে-জীবনটি গ্রহণ করেছিলেন, আপাতদৃষ্টিতে সেটি যেন সাধারণ এক মানবীমূর্তি। সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ, আত্মীয় স্বজন, পারিবারিক জীবনের দায়দায়িত্ব, সবকিছু নিয়ে সেই জীবনের প্রকাশ। তার মধ্যে আবার অভাব-অনটনের জ্বালাও প্রবল। মায়ের আমাদের এমনও দিন গেছে, যখন ভাতের উপর লবণ জোটে নি।
তবু কী শান্ত, সংহত, প্রশান্ত! কিছুতেই কিছু এসে যায় না। কারও প্রতি কোনও অভিযোগ নেই, কাউকে জানান না কোনও অসুবিধা। মানবী হয়েও দেবী। যেন জীবনটিই তার এক গভীর তপস্যা। মা সারদাদেবী স্নেহের আধার, করুণার পারাবার, অনুপম এক মাতৃমূর্তি। একটি শান্ত মাতৃত্বের ভাব তাঁর বাল্যকাল থেইে। জয়রামবাটীতে একবার প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ, মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছে। সেই সময়–বিত্তে দরিদ্র কিন্তু চিত্তে পরম ঐশ্বর্যবান সারদা-জনক রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তার সংসারের জন্য রক্ষিত সম্বৎসরের চাল গোলা উজাড় করে ঢেলে দিলেন ক্ষুধার্তের জন্য। দলে দলে লোক আসে, ফুরিয়ে যায় খিচুড়ি, আবার চাপে উনানে, খিদের সময় গরম খিচুড়ি লোকেদের খেতে কষ্ট হচ্ছে দেখে বালিকা সারদা দুহাতে পাখা নিয়ে বাতাস করতে থাকেন তাদের ও আহা, এত গরম খাবে কি করে! জুড়োক।
যে যেখানে তাপদগ্ধ আছে, এসে জুডোেক। তার কাছে আছে মলয় বাতাসের পাখা–যার বাতাসে বাঁশ আর ঘাস ছাড়া সব কাঠ চন্দন হয়ে যায়। আহা, বাঁশ আর ঘাসের তাহলে উদ্ধার হবে না?
তা-ও হবে।
মূর্তিমতী সেবা, মূর্তিমতী করুণা এসে দাঁড়িয়েছেন যে মানুষের ঘরের মধ্যে, দেবেন তাদের চন্দন করে।
প্রদীপের নীচেই অন্ধকার। মায়ের নিকট-আত্মীয়জনেরা তার স্বরূপ চিনতে পারে না। ভক্তদের সঙ্গে তাই আত্মীয়দের সব সময় মতের মিল থাকে না। মনান্তর ঘটে।
জয়রামবাটীতে গিরিশ ঘোষের সঙ্গে কালীমামার তুমুল তর্ক–মা দেবী কি না এই নিয়ে।
কালীমামা চিরদিনই তাকে দিদি বলেই জানেন। দিদির কাছে কত আবদার, কত জাগতিক প্রত্যাশা। হঠাৎ সেই দিদিটি দেবী হয়ে উঠলে তাঁর সহ্য হবে কেন? বলেই বা কি করে? তাই তর্ক তুমুল পর্যায়ে ওঠে।
কিন্তু অবশেষে গিরিশবাবুরই জিত! ভীত সন্ত্রস্ত পরাস্ত কালীমামা শরণ নিতে এলেন মা মহাশক্তির কাছে।
শ্রীমা তাড়াতাড়ি নিরস্ত করে বলেন : ওরে কালী, আমি তোর সেই দিদি। আজ তুই এ কি করছিস?
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন ভাই। আঃ কী শান্তি!
যে যেভাবে শান্তি পায়। কেউ দেবীভাবে পেয়ে, কেউ দিদি, পিসী, খুড়ী ভাবে পেয়ে। তবু জানে এখানেই পরম শান্তি, পরম স্বস্তি, অগাধ স্নিগ্ধচ্ছায়া।
লোকশিক্ষার্থেই শ্রীমার এই দুইসত্তার ভূমিকায় প্রকাশ। দেবীসত্তা আর মানবীসত্তার এক অনায়াস সমন্বয়। সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি ধারাকে কি অসীম শক্তিতে এমন শান্ত গতিতে সমান্তরালধারায় প্রবাহিত করা যায়, তা ভাবতে গেলে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয়।