আমি বললাম, ‘এই গুরুর হাতেই রইল দীক্ষাশিক্ষার ভার, তাই গুরুছাড়া গৌরভজন হল অসাধ্য। ভক্ত আর গৌরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন গুরু। এদিনে বৈষ্ণব-আচারের বই ‘হরিভক্তিবিলাস’ স্পষ্টই ব্রাহ্মণের স্বার্থ দেখল বড় করে। ব্রাহ্মণ মানে ‘ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব’। হরিভক্তি বিলাস মেনে নিল সমাজের বর্ণভিত্তি, ব্রাহ্মণের শীর্ষভূমিকা। এই শাস্ত্র শূদ্রদের বিরুদ্ধাচরণ করল, শূদ্রদের কাছ থেকে কোনও দান গ্রহণে দিল নিষেধাজ্ঞা এমনকী চণ্ডালকে দেখলে প্রায়শ্চিত্তের বিধান দিল। ফতোয়া জারি করল যে, ব্রাহ্মণ শুরু শ্রেষ্ঠ এবং সববর্ণের মানুষকে দীক্ষা দিতে পারে ব্রাহ্মণ। অবশ্য বলা হল শূদ্রও দীক্ষা দিতে পারে তবে স্ববর্ণে বা আরও নীচের বর্ণস্তরে কিন্তু কখনই ব্রাহ্মণকে নয়।’
বন্ধু বললেন, ‘ওই জন্যেই নিম্নবর্ণের মানুষ চলে গেল সহজিয়া লাইনে। নিম্নবর্ণে তো সংস্কৃতে লেখা ‘হরিভক্তিবিলাস’ চলত না, ব্রাহ্মণরাও ছিল ওদের সম্পর্কে নিস্পৃহ। তাদের নজর ছিল মহন্তগিরির দিকে। আর এই সুযোগে অল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত এমনকী বিকৃত বুদ্ধি অনেক মানুষ শূদ্রদের গুরু সেজে বসল। ওরা তাদের মতো ব্যাখ্যা করল পরকীয়াবাদের, মঞ্জরী সাধনার, চৈতন্যের গুহ্যসাধনার। কে সে সব দেখতে গেছে তখন? এইখানে রমাকান্ত চক্রবর্তীর বক্তব্য শুনুন। Society and change পত্রিকার প্রথম খণ্ড চতুর্থ সংখ্যা থেকে আমি পড়ছি:
Non-Brahmana Vaisnava gurus sought new field in rural and tribal areas when they freely preached their own versions of the legends of Radha Krishna and Caitanya. Most of these versions were deeply mixed with sex and fundamentally different from the orthodox Vaisnava concepts which had been couched in Sanskrit and which were, therefore, incom-prehensible to the common people.
এই মন্তব্য শুনেই আবার মনে পড়ে গেল গোরাডাঙ্গা গ্রামের মযহারুল খাঁ-র কথা। নিজে পদও লেখেন। উনি আমাকে একবার বলেছিলেন চৈতন্য ভাগবতের অন্ত্যখণ্ড পড়তে, সেখানে নাকি লেখা আছে চৈতন্য নয় নিত্যানন্দই আসল। খুঁজে খুঁজে জায়গাটা বার করলাম। পানিহাটি গ্রামে রাঘব পণ্ডিতকে মহাপ্রভু বলেছিলেন,
রাঘব তোমারে আমি নিজ গোপ্য কই।
আমার দ্বিতীয় নাই নিত্যানন্দ বই॥
এই নিত্যানন্দ যেই করাবেন আমারে।
সেই করি আমি এই বলিল তোমারে॥
আমার সকল কর্ম নিত্যানন্দ-দ্বারে।
এই আমি অকপটে কহিল তোমারে॥
এর পরে যখন ময্হারুল ফকিরের কাছে আবার গেলাম তখন জানতে চাইলেন চৈতন্য ভাগবতের সেই জায়গাটা খুঁজে পেয়েছি কি না। যেই ঘাড় নাড়লাম অমনি ফকির বললেন, ‘বলুন তো নিত্যানন্দ-দ্বার মানে কী? বলতে পারলেন না তো? ওর মানে স্ত্রী লোকের যোনি। গৌরাঙ্গ ঠারেঠোরে বলে গেছেন চৈতন্যতত্ত্বের মূল বুঝতে গেলে নিত্যানন্দ-দ্বারে যেতে হবে।’
ঘরে হঠাৎ বাজ পড়লেও এতটা চমকাতাম না, সেদিন যা চমক লেগেছিল। ব্যাখ্যার চকিত অভিনবত্বে শুদ্ধ শাস্ত্র কীভাবে উলটে দেওয়া যায় তার চরম নমুনা বোধহয় ময্হারুল দিলেন। কিন্তু এ তো তাঁর নিজের উদ্ভাবন নয়, কথাটা মুখে মুখে গোপনে চলছে বাউল ফকিরদের ভেতরে ভেতরে কয়েক শতক নিঃসন্দেহে। শাস্ত্রকে দুভাবে ব্যাখ্যা যে কতরকম স্তরে হতে পারে তার নানা রোমাঞ্চকর নমুনা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে পাওয়া যায়। আজ পর্যন্ত খুব ভালভাবে এদিকটা অনুধাবন করা হয়নি। কিন্তু বিশেষভাবে বলবার কথা হল ময্হারুল ফকির বা তাঁর পূর্ব পূর্ব লোকায়ত গুরু কয়েক শতক ধরে ‘নিত্যানন্দ-দ্বার’ বলতে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা বেশ অনেক দূর পর্যন্ত চারিয়ে গেছে। এ সব শুনে অনেকে বিরক্ত হবেন, নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব মনে খুব আঘাত পাবেন, কিন্তু লোকায়ত বিশ্বাসকে তো টলানো যাবে না। লৌকিক গুরু বৈরাগী উদাসীনরা এমন অনেক কথা বৈধী ধারার সমান্তরালে চিরকাল বলে গেছেন যাচ্ছেন এবং যাবেন।
আসলে জট পাকিয়ে আছে চারশো বছর আগে থেকে। চৈতন্য-নিত্যানন্দ-অদ্বৈত-গদাধর-শ্রীবাস পর্বের পর বাংলার বৈষ্ণবধর্ম যে বিচ্ছিন্নতা ও শীর্ণতার মধ্যে আত্মকুণ্ঠ হয়ে পড়ে তার থেকে তাকে বাঁচাতে বৃন্দাবন থেকে শ্রীজীব গোস্বামীর দীক্ষিত-শিক্ষিত নরোত্তম-শ্রীনিবাস-শ্যামানন্দ এবং পরে কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, নরহরি ও রাধামোহন যতই চেষ্টা করুন তবু বৈষ্ণবধর্মের পতন ও বিচ্ছিন্নতা রোখা যায়নি। খেতুরিতে মহাসম্মেলন ডেকে সপ্তদশ শতকের শেষার্ধে নরোত্তম বাংলার সব বৈষ্ণব নেতাকে এক জায়গায় বসিয়ে সমন্বয়ের শেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু হরিভক্তিবিলাসের কাঠিন্য, শুদ্ধিকরণ আর ব্রাহ্মণত্বের নেতৃত্ব কি ঠেকাতে পারে কোনও স্ফূর্ত বৈষ্ণব গণশক্তিকে? মহাসম্মেলনে সেই মানুষগুলোকে ডাকা হল কই যারা অবহেলিত মানহারা? ‘জাত বৈষ্ণব’ নাম দিয়ে তাদের কি কেবলই ঠেলে দেওয়া হয়নি ভ্রষ্টবুদ্ধি মূর্খ গুরুদের হাতে? আর সেই সুযোগে প্রকৃতি-সাধনার এক জীবনস্পন্দী আহ্বানে সহজিয়া আর বাউল ফকিররা কি ধীরে ধীরে অশিক্ষিত নিম্নবর্গের অনেককে টেনে নেয়নি রসের পথে? এইভাবেই ঐতিহাসিক পুরুষ শ্রীচৈতন্য হয়ে যান গোপ্য সাধনার এক স্তরান্বিত সংকেত। নিত্যানন্দ হয়ে যান দেহকেন্দ্রিক যৌনসাধনার এক গূঢ় ইঙ্গিত। কৃষ্ণ আর রাধাকে তত্ত্বরূপে ‘আরোপ’ করা হয় মানুষ-মানুষীর শরীরী মিলনে। অন্য দিকে নৈষ্ঠিক বৈষ্ণবরা ব্যস্ত থাকেন কৃষ্ণরাধা আর গৌরাঙ্গকে দারুভূত বা প্রস্তরীভূত মূর্তি করে মঠে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা দিতে। গড়ে তোলেন তাঁরা পূজা ও বিধান, শাস্ত্র ও পদাবলী। সবকিছুকে ঐশী ও অপ্রাকৃত বিশেষণ দিয়ে প্রবহমান জীবনের উলটো মুখে নিশ্চিন্তে বসতে চান তাঁরা। ‘চৈতন্যের মর্ম লোকে বুঝিতে নারিলা’ তো সত্যিই এক ট্র্যাজিক উচ্চারণ।