‘এই দেবমহান্ত ব্যাপারটি কী?’ আমি জানতে চাই।
সত্যশিব পাল দেবমহান্ত দুলালচাঁদের চতুর্থ পুরুষের উত্তরাধিকারী। শালপ্রাংশু চেহারা। বললেন: দেবমহান্ত একটি টাইটেল। আমাদের বংশে রামদুলাল এই উপাধি পান নদীয়ার মহারাজার কাছ থেকে।
:কী কারণে টাইটেলটা পান তিনি?
: ব্যাপার কী জানেন, বৈশাখী পূর্ণিমাতে ঘোষপাড়ায় রথযাত্রা হত, এখনও হয়। নদীয়ার মহারাজা একবার বললেন বৈশাখ মাসে রথ অশাস্ত্রীয়, কাজেই তা বন্ধ করতে হবে। তিনি জোর করে রথযাত্রা বন্ধের আদেশ দেন। তখন ভক্তরা দুলালচাঁদকে রথে বসায় আর বিনা আকর্ষণে রথ চলতে থাকে। সেই ঘটনায় দুলালচাঁদ দেবমহান্ত হন।
কিংবদন্তির ধোঁয়াশা কাটাতে আমার ঝটিতি জিজ্ঞাসা ‘ঘোষপাড়ার এরিয়া কতটা?’
: দক্ষিণে কল্যাণী উপনগরী, উত্তরে চরবীরপাড়া, পূর্বে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমে চরসবাটি এই হল সীমা। এখন আমাদের ঠাকুরবাড়ি সংলগ্ন জমির পরিমাণ ৬.২৯ একর। আগে ঘোষপাড়ার মেলা ৬০০ বিঘা আমলিচুর বাগান সমেত জমিতে বসত। প্রায় সাড়ে তিন হাজার গাছ ছিল। একেক গাছের তলায় একেক ‘মহাশয়’ তাঁর দল নিয়ে বসতেন। তারপরে গত যুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকার জমি নিয়ে নেন। যুদ্ধের পরে সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগ মেলার জন্যে ওই ৬০০ বিঘা ছেড়ে দেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার মেলার জন্যে মাত্র ৩০ একর জমির সংরক্ষিত রাখেন। তারমধ্যে আবার জবরদখল ঘটেছে। গড়ে উঠেছে কলোনি। মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে।
রয়েল ফকিরের সঙ্গে প্রথম যাওয়ার পর অবশ্য আরও অন্তত দশবার গেছি ঘোষপাড়ার মেলায়। শুধুই মনে হয়েছে মেলায় দিনে দিনে যত লোক বাড়ছে ততই জায়গা কমছে। কিন্তু সে কথায় যাবার আগে রয়েল ফকিরের ঘটনাটা শেষ করি। দোলের আগের দিন সকালে ফকির আমাকে নিয়ে বিরাট মেলা চত্বরের নানাদিকে ঘোরালেন আর চেনালেন সবকিছু। ‘এই হল হিমসাগর, এখানে কাল চান করবে ভক্তবৃন্দ’ আর ব্যাধিগ্রস্তরা।’ ‘ওই দেখুন ডালিমতলা। এখানকার মাটি মাখলে আর খেলে সব রোগের মুক্তি।’ ‘চলুন একটু পুবদিকে যাই, ওখানে অনেক বাউল ফকির দরবেশ আসেন।’ হঠাৎ রয়েল ফকির বলে বসেন, ‘এই এই তো শিবশেখরের আসন। আসুন বাবা, এখানে বসুন।’
শিবশেখর হলেন এক চুল কোঁকড়ানো সুগঠন যুবা। ভক্তিমানের মতো মাথা নিচু করলেন। রয়েল বললে, ‘এঁদের এক মস্ত “মহাশয়” বংশ মুর্শিদাবাদ জেলার কুমীরদহ গ্রামে।’ সবাই বসলে আমি বললাম, ‘এই “মহাশয়” ব্যাপারটি কী বলুন তো?’
শিবশেখর বললেন, ‘এখানে ঘোষপাড়ায় নিত্যধামে আমাদের মূল “আসন”। এখানকার যাঁরা প্রত্যক্ষ শিষ্য তাঁদের মধ্যে যাঁরা ভক্তিমান ও অবস্থাপন্ন তাদের বাড়িতে “আসন” থাকে। তাঁরা দীক্ষা দেন। এঁদের বলে “মহাশয়”। আর মহাশয়রা যাঁদের শিষ্য করেন তাঁদের বলে “বরাতি”।’
: আপনারা ক পুরুষের মহাশয়?
: আমাকে নিয়ে ছয় পুরুষ চলছে। ছ পুরুষ আগে আমাদের পূর্বপুরুষ নফর বিশ্বাস, ভোল্লাগ্রামের মহাভারত ঘোষ আর হরিহর পাড়া-মালোপাড়ার তেঁতুল সেখ এই তিনজন ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে দীক্ষা দেন। তারিখ ছিল ২৮শে কার্তিক। সেই থেকে ২৮শে কার্তিক আমাদের কুমীরদহ গ্রামে মহোৎসব হয়। আপনি এবারে যাবেন। খুব জাঁক হয়।
: আপনার ছ পুরুষের নাম বলতে পারেন?
: আজ্ঞে হ্যাঁ। লিখে নিন। আমার নাম শিবশেখর মণ্ডল। আমার বাবা যদুলাল মণ্ডল, তাঁর বাবা দুকড়ি, তাঁর বাবা চাঁদ সিং, তাঁর বাবা ফতে সিং, তাঁর বাবা নফর বিশ্বেস।
জবাব শুনে আমি তো অবাক! বিশ্বাস থেকে মণ্ডল, মাঝখানে আবার সিং? খানিকটা সংকোচ নিয়েই বলি: আপনারা কি তবে মাহিষ্য?
: আমরা মুসলমান।
বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়। নাম শিবশেখর, পিতা যদুলাল অথচ জাতে মুসলমান? দেখি, রয়েল ফকির মিটিমিটি হাসছে। ভাবখানা যেন, ‘বাবু এই মজা দেখাতেই তো আপনাকে আনা।’ ‘মানুষের কারবার দেখলি আপনি তাজ্জব হয়ে যাবা।’
শিবশেখর বলে, ‘বাবু জন্মে আমরা মুসলমান তবে কর্মে এই সতী মার দোরধরা।’
: মুসলমান ধর্ম পালন করেন না?
: বাড়িতে ঈদ্গাহ আছে। দুই ঈদ পালন করি। মসজিদে যাই না। বাড়িতে ছ পুরুষের পুজো করা আসন আছে। সতী মার ঘটে প্রত্যেক শুক্রবার উপাসনা সিন্নিভোগ হয়।
: খাওয়া-দাওয়ার কোনও বিধি আছে নাকি?
: তেমন আর কী? শুধু সম্বৎসর নিরামিষ খাই বাড়ির সকলে।
নিরামিষভোজী মুসলমান তায় আবার নাম শিবশেখর! এমন একটা বিস্ময়ের ধাক্কা সামলানো কঠিন বইকী। জাতাজাতির সংস্কার এমন বদ্ধমূল এই উচ্চশিক্ষিত মনেও সে অঙ্ক মেলে না। আমার বিপন্নতা দেখে রয়েল ফকির শিবশেখরের আখড়ার গাহককে রহস্যময় হেসে কানে কানে কী একটা গান গাইতে বলে। সে সঙ্গে সঙ্গে একতারা বাজিয়ে গান ধরে:
জাত গেল জাত গেল ব’লে
এ কি আজব কারখানা।
সত্য কথায় কেউ রাজি নয়
সবই দেখি তা না না না॥
কী আশ্চর্য, রয়েল ফকির কি তবে আমাকে তা না না না-র দলে ফেলে দিল? ততক্ষণে সেই অজানা গ্রাম্য গায়ক ভ্রূকুটি করে সরাসরি আমাকেই যেন জিজ্ঞেস করে বসে তার গানের অন্তরায়:
এই ভবেতে যখন এলে
তখন তুমি কী জাত ছিলে?
যাবার সময় কী জাত হবে
সে কথা তো কেউ বলে না॥
ব্রাহ্মণ চাঁড়াল চামার মুচি
এক জলে হয় সবাই শুচি
দেখে কারও হয় না রুচি