রামপ্রসাদের কথা আপনাদের নিশ্চয় অজানা নয়। জমিদারী সেরেস্তায় খাতা লিখতেন। হাতে কাজ নেই, অথচ নায়েব মশাইকে দেখাতে হবে বড় কাজে ব্যস্ত। অনন্যমনা হয়ে ঘাড় গুঁজে খাতা লিখে চলেছেন।
একদিন নায়েবের কৌতূহল হল। লোকটা এত কি হিসাব লেখে দেখা দরকার। খাতা তলব করলেন, বেরিয়ে পড়ল বিখ্যাত শ্যামা সংগীতআমায় দে মা তবিলদারি।
মপাসাঁ কোন কালেই হয়তো গল্প লিখতেন না। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একটি গল্প লিখে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। এমিল জোলা তখন ফরাসী সাহিত্যের নবীন লেখকদের গুরুস্থানীয়। তাঁর নেতৃত্বে একটি সাহিত্যচক্র গড়ে উঠল, তখনকার নবীন সাহিত্যিকরা একে একে এই চক্রে যোগ দিলেন। মপাসাঁও ছিলেন এই দলের একজন সভ্য। বাস্তববাদী সাহিত্যিক নামে এই দলটি তখন ফ্রান্সে সবে শোরগোল তুলেছে।
তখন ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ চলেছে। মপাসাঁ ও তার কয়েকজন বন্ধু যুদ্ধের প্রতি খুবই বিরূপ ছিলেন। যুদ্ধের বীভৎসতা মানুষকে অমানুষ করে দেয়, যুদ্ধকে তাই ঘৃণা করতেন। কিন্তু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলে তো কাজ হবে না, দেশবাসীর সামনেও যুদ্ধের বীভৎসতার দিকটা তুলে ধরা দরকার। স্থির হল বন্ধুরা প্রত্যেকেই একটি গল্প লিখবেন। এই প্রস্তাবের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জোলা। তিনি নিজে তো গল্প লিখবেনই, বই আকারে প্রকাশের ভারও তিনি নিলেন। মপাসাঁকে প্রতিশ্রুতি দিতে হল গল্প লেখার। কিন্তু কি লিখবেন? গল্প তো কখনও লেখেন নি। মনে পড়ে গেল ওঁর কাকার কাছে শোনা একটি ঘটনা, স্থির করলেন সেইটি নিয়েই গল্প লিখবেন। যথা সময়ে লিখলেন গল্প। নাম দিলেন ব দ্য সুফ-বল্ অফ ফ্যাট। এই একটি গল্প লিখেই মপাসাঁ। সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা পেলেন এবং গল্পটি আজও মোসর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পরূপে সমাদৃত।
অত দূরে যাবার দরকার কি। ঘরের কাছেই তো দুটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে, লেখক হওয়াটা যাদের জীবনে একটা অ্যাকসিডেন্ট। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর সুবোধ ঘোষের কথাই বলছি। মানিকবাবু তখন কলকাতার কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্সের ছাত্র, থাকেন একটা মেস্-এ। একদিন মেস্-এর বন্ধুদের সঙ্গে জোর তর্ক চলছিল। বিষয়টা ছিল, পত্রিকাসম্পাদকরা অপরিচিত লেখকের লেখা ছাপে না। মানিকবাবু প্রতিবাদ করলেন। লেখার মধ্যে যদি প্রতিশ্রুতি থাকে সম্পাদকরা নিশ্চয় সে-লেখা ছাপবে। মানিকবাবুর যুক্তি ছিল অপরিচিত লেখকের ভাল লেখা না ছাপাটা পত্রিকার পক্ষে সুইসিড্যাল পলিসি। বন্ধুরা মানিকবাবুর কথা মানতে রাজী নন, প্রমাণ চাই। মানিকবাবু বরাবরই একগুঁয়ে মানুষ। বললেন, প্রমাণ দেবেন। পাঁচ টাকা বাজি হয়ে গেল। সাতদিনের মধ্যে একটা গল্প লিখে তখনকার বিখ্যাত পত্রিকা বিচিত্রায় পাঠিয়ে দিলেন। পরের মাসেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অতসী মামী প্রকাশিত হল। তার কিছুদিন পরে বিচিত্রার সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ঠিকানা খুঁজে বার করে স্বয়ং মানিকবাবুর মেস্-এ এসে হাজির। গল্পের পারিশ্রমিক বাবদ পনেরোটা টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে আরও গল্প লিখবার অনুরোধ জানিয়ে গেলেন। মানিকবাবুর সাহিত্য-জীবনের সেই শুরু।
সুবোধবাবুর প্রথম লেখা গল্প অযান্ত্রিক-এর ইতিহাস তো সবারই জানা। কোন দিন লেখক হবেন, স্বপ্নেও ভাবেন নি সুবোধবাবু। হাজারিবাগের রুটির ব্যবসা গুটিয়ে ভাগ্যান্বেষণে এলেন কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকায় সাব-এডিটরের চাকরি পেয়ে গেলেন। মন্মথনাথ সান্যাল, অরুণ মিত্র, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, বিজন ভট্টাচার্য, বিনয় ঘোষ প্রভৃতি মিলে একটা পাঠচক্র করেছিলেন। প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় নিয়মিত তারা একত্রে মিলিত হতেন এবং এক-এক শনিবার এক-একজনকে কিছু একটা লিখে এনে পড়ে শোনাতে হত। সুবোধবাবু শ্রোতারূপেই এই চক্রে যোগ দিয়ে আসছেন। একদিন বন্ধুরা ধরলেন, পরের শনিবার সুবোধবাবুকে কিছু-একটা লিখে এনে পড়ে শোনাতে হবে। সুবোধবাবুর মাথায় বজ্রাঘাত। জীবনে এক লাইন লেখেন নি, কী লিখবেন। বন্ধুরা নাছোড়বান্দা, লিখতেই হবে। নিরুপায় হয়ে কথা দিলেন। কিন্তু সপ্তাহ ঘুরে এল, কিছুই লেখা হল না। শুক্রবারেও বন্ধুরা স্মরণ করিয়ে দিলেন লেখার কথা। সারাদিন আপিসের কাজকর্ম সেরে মার্কাস স্কোয়ারের কোণার মার্কাস বোডিং-এ ফিরে গেলেন, লেখার কথাটা বোঝার মত মাথায় চেপে আছে। রাস্তার পাশে এক তলার একটি ঘরে তখন থাকতেন। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর কাগজ-কলম নিয়ে বসলেন, কিছু একটা লিখতেই হবে। লেখা যখন শেষ করলেন তখন ভোর চারটে। লেখাটা পকেটে করে অফিসে এলেন, বন্ধুরা লেখার কথা জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকেন। সন্ধ্যায় যথারীতি আসর বসল, সুবোধবাবু সঙ্কোচের সঙ্গে পকেট থেকে পাণ্ডুলিপি বার করে পড়লেন সেই বিখ্যাত গল্প অযান্ত্রিক। এই একটি গল্প লিখেই সুবোধবাবুর স্থান বাংলা সাহিত্যে পাকা হয়ে গেল। সুতরাং সুবোধবাবুরও লেখক হওয়াটা অ্যাসিডেন্ট ছাড়া আর কি। এদের তুলনায় জগদীশ গুপ্তর লেখক হওয়ার ঘটনাটা আরও কৌতুকপ্রদ।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর বাংলা সাহিত্যে যে আলোড়ন দেখা দিয়েছিল তার প্রবর্তনে জগদীশ গুপ্ত ছিলেন অন্যতম পুরোধা। শরৎচন্দ্রের পর নূতন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে তার লেখা প্রবাসী-ভারতবর্ষ প্রমুখ বিশিষ্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হতে লাগল, সে-লেখায় সমাজ-জীবনের বাস্তবরূপ রোষ-কষায়িত ভঙ্গীতে ব্যক্ত। পড়ে চমকে উঠতে হয়। তাঁর লেখায় শ্লেষ আছে, ব্যঙ্গ আছে, হাসি আছে আর আছে জীবন সংগ্রামে জর্জরিত একটি মানুষের দরদী দৃষ্টি। কল্লোল ও কালিকলমের একাধিক লেখক যে জগদীশ গুপ্তর কাছে ঋণী একথা অস্বীকার করবার নয়।