দীনেশবাবু বললেন–দাঁড়া, অত ব্যস্ত হলে চলবে না, তৈরি হয়ে নিই।
দেখা করতে যাবে তৈরি হবার কী আছে। কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না মতিলাল। দীনেশবাবু বললেন–সামনের রবিবার যাব। হাতে চারদিন সময় আছে, এর মধ্যে বই যোগাড় করে ভাল করে পড়ে নিতে হবে। ইমপ্রেস করতে হবে তো।
বঙ্কিমচন্দ্রকে সাহিত্যের আলোচনায় একবার ইমপ্রেস করতে পারলেই বঙ্গদর্শন পত্রিকার নিয়মিত লেখক হবেন, এই আশায় চারদিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে সাহিত্যের মোটা মোটা বই পড়ে ফেললেন। বঙ্কিমচন্দ্রের সবগুলি উপন্যাসের উপর আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, ওদিকে হোমর, দান্তে, শেক্সপীয়র, দার্শনিক কেঁাৎ আরেকবার ঝালিয়ে নিলেন। কি কি বিষয় নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করবেন, বঙ্কিম রচিত উপন্যাসের কোন্ কোন চরিত্রের কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন তার একটা খসড়া মনে মনে প্রস্তুত করে ফেললেন। শুধু তাই নয়। বঙ্কিমবাবুর বিশেষ পরিচিত বন্ধু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কালীপ্রসন্ন সরকারের কাছ থেকে একটি পরিচয়পত্রও জোগাড় করে ফেললেন। কালীপ্রসন্নবাবু কুমিল্লায় থাকাকালে গীতার ইংরেজী অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদের কাজে দীনেশবাবু তাকে সাহায্য করেছিলেন— পরিচয়পত্রে সে কথারও উল্লেখ ছিল। অর্থাৎ বঙ্কিমবাবুকে ইমপ্রেস করবার তাবং অস্ত্র শানিয়ে রবিবার বেলা দুটোয় মতিলালকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্কিমসঙ্গমে বেরিয়ে পড়লেন।
বঙ্কিমবাবু তখন থাকতেন কলেজ স্ট্রীট পাড়ার প্রতাপ চাটুজ্যের গলিতে। খোঁজ করতে করতে যখন তারা বাড়িটার সামনের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন, হঠাৎ ভিতর থেকে প্রচণ্ড চিৎকার শোনা গেল
পাজি হতভাগা গাধা, বোজ দুপুরে কাজ ফাঁকি দিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমনো? ভেবেছিস আমি কিছু টের পাই নে? বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা আমার সামনে থেকে নচ্ছার কোথাকার–দূর হয়ে যা।
সুর সপ্তমে তুলে গালি-গালাজ চলছে এক নাগাড়ে। যার প্রতি গালি বষিত হচ্ছে, সে পক্ষের তরফ থেকে কোন উচ্চবাচ্য নেই।
খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দীনেশবাবু দেখলেন এক নগ্নদেহ গৌরবর্ণ বৃদ্ধ তার সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চাকরকে অনর্গল বকুনি দিয়ে চলেছেন। দুটি অপরিচিত যুবক দরজায় উঁকি মারছে দেখে বৃদ্ধ একটু
অপ্রস্তুত হয়ে চাপা গম্ভীর গলায় গৃহভৃত্যকে বললেন–
আচ্ছা তুই এখন যা।
ভৃত্য সামনে থেকে চলে যেতেই আগন্তুক যুবকদের দিকে তাকিয়ে বললেন–আপনারা কাকে চান?
সপ্রতিভ হয়েই দীনেশবাবু বললেন—আমরা বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
বৃদ্ধ বললেন–কোত্থেকে এসেছেন, কি দরকার?
দীনেশবাবু বললেন—আমরা কুমিল্লা থেকে এসেছি, বঙ্কিমবাবুর শুধু একবার দর্শন পেতে চাই।
বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ দক্ষিণ দিকের একটা সিঁড়ি দেখিয়ে বললেন–ওই সিঁড়ি দিয়ে উপরের ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করুন, তাকে খবর দিচ্ছি।
যাক, তাহলে বঙ্কিমবাবুর দেখা পাওয়া যাবে। দুজনে হর্ষোৎফুল্ল হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলেন। মাঝারি মাপের ঘর। এক কোণায় একটি টেবিল অর চার পাশে চারটি চেয়ার। ঘরে আসবাবের বাহুল্য নেই, বৈঠকখানা ঘর বলেই ওঁদের মনে হল। পাশাপাশি দুটি চেয়ার টেনে দুই ভাই অধীর আগ্রহে বসে আছেন বঙ্কিমবাবুর আগমন প্রতীক্ষায়।
দীনেশবাবু ধ্যানস্থ হয়ে মনে মনে ঝালিয়ে নিচ্ছেন বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে সাহিত্যের কোন্ কোন্ বিষয়ে কি কি আলোচনা পর পর চালাবেন। মতিলাল অবাক হয়ে আসবাবহীন ঘরটার চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে আর ভাবছেএতবড় নামজাদা লেখক ও সম্পাদক অথচ ঘরে না আছে আসবাবপত্র, না আছে আলমারিভর্তি মোটামোটা সংস্কৃত আর ইংরেজী বই, এমন কি বঙ্গদর্শন পত্রিকার নতুন বা পুরোনো কোন সংখ্যাই ঘরের আনাচে-কানাচে কোথাও দেখতে পেল না। বিদ্যাসাগরের ঘরে ঢুকে চারিদিকের পাণ্ডিত্যের পরিবেশ দেখে ও যেমন বিস্মিত হয়েছিল, এখানে তার কোন পরিচয় না পেয়ে দমে গেল।
মিনিট তিন-চার নীরব প্রতীক্ষার পর হঠাৎ চটি জুতোর খসখস আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে দরজার দিকে তাকিয়েই দীনেশবাবু ও তার মামাতো ভাই মতিলালের চক্ষুস্থির। ইনিই সেই নগ্নদেহ বৃদ্ধ-রুদ্রমূর্তি ধারণ করে যিনি চাকরকে তারস্বরে বকুনি দিচ্ছিলেন। এখন আর নগ্নদেহ নেই, পরনে নতুন পাটভাঙ্গা শান্তিপুরী ধুতি আর গিলে-হাতা কামিজ। বুঝতে অসুবিধে হল
যে, যার দর্শনপ্রার্থী হয়ে এসেছেন ইনিই সেই স্বনামধন্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ঘরে ঢুকেই বঙ্কিমবাবু টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারে বেশ ভব্যসব্য হয়ে বসলেন। মুখে প্রশান্ত গাম্ভীর্য, দৃষ্টিতে অতলান্ত সমুদ্রের গভীরতা। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, দাড়ি-গোঁফ মসৃণভাবে কামানো, মুখের হাঁ একটু বড়, দীর্ঘাকৃতি।
চেয়ারে বসেই হাত বাড়িয়ে কালীপ্রসন্ন সরকারের চিঠি দীনেশবাবুর হাত থেকে নিয়ে এক নিশ্বাসে পড়েই প্রশ্ন করলেন—কালীবাবু কি এখনও কুমিল্লাতেই আছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ, উনি যে গীতার অনুবাদ করছিলেন—
কথা শেষ করতে না দিয়েই বঙ্কিমবাবু বললেন—ওঁর শরীর এখন সুস্থ আছে তো?
হ্যাঁ, শরীর ভালই। তবে গীতার ইংরেজী অনুবাদের কাজে আমরা দুজনে যে পরিশ্রম–
ওঁর যে মৈমনসিং-এ বদলি হবার কথা ছিল, তা হন নি দেখছি। কুমিল্লা জায়গাটা কেমন?
জায়গাটা মফস্বল শহর হিসেবে ভালই। তাছাড়া এই জেলার অনেক প্রাচীন পুথি আছে, আমি সংগ্রহ করেছি—
ওখানকার জলবাতাস কি রকম। শুনছি খুব বৃষ্টি হয়। তা হয়।