সে কি! আর কেউ আসে নি?
চিঠির প্যাড থেকে মুখ না তুলেই বললাম—
না আসুক। তাই বলে এক্ষুনি পরচর্চা শুরু করতে পারব না। আগে চিঠিটা শেষ করে নিই।
টেবিলে কয়েকটা সদ্য প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ছিল। সেগুলি এগিয়ে দিয়ে আবার চিঠির কাগজে মনোনিবেশ করলাম। চিঠিটা প্রায় যখন শেষ করে এনেছি, এমন সময় একটি যুবক খুবই সঙ্কোচের সঙ্গে ঘরে ঢুকল। অচেনা ব্যক্তিকে অসময়ে অপ্রত্যাশিতভাবে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে যুবকের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন–আপনি কি-ইয়ে—
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম—আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, আমিই ইয়ে। আপনার কিছু বলবার আছে?
না।
তাহলে—
দেখতে এসেছি।
কী দেখতে এসেছেন?
আপনাকে।
চমকে উঠলাম। আমাকে দেখতে এসেছে। আর কোনও প্রয়োজন নেই শুধু দেখতে আসা। এ-রকম আগন্তুকের সঙ্গে এর আগে কখনও মুখোমুখি হবার সুযোেগ আমার হয় নি। দেখে তৃপ্ত হবে এমন কোন রূপ বা গুণ আমার চেহারায় নেই। তবু যুবকটি মুখে একটা পরিতৃপ্তির গদগদ হাসি এনে আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে আছে, মুখে কোন কথা নেই। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, অপরিসীম অস্বস্তি।
গাল্পিক-সাহিত্যিক এতক্ষণ একটা মাসিক পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে মগ্ন ছিলেন, যুবকটির দিকে একবার তাকিয়েই বললেন—আমি একটু ঘুরে আসছি। নস্যি ফুরিয়ে গিয়েছে, কিনতে হবে।
ছোকরা আমার হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও ওঁর নিজে নস্যি কিনতে যাওয়ার গুরুত্ব বুঝতে বিলম্ব হয় নি। পাছে উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠেন, তাই পলায়ন। একাকী যুবকটি সামনে দাঁড়িয়ে, ঠোঁটের কোণায় সলজ্জ মৃদু হাসি। ওঁর কোন বক্তব্য নেই, সে-তো আগেই জানিয়েছেন। তাই কথা কিছু বলছেন, শুধু চেয়ে আছেন। যেন আমার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া ওঁর আর কোন কিছু করবার নেই। এমন অসহায় অবস্থায় আর কতক্ষণ থাকা যায়। অগত্যা বসতে বলে প্রশ্ন করলাম—আপনি কি কলকাতায় থাকেন?
না, আমি থাকি অনেক দূরে, চিরিমিরিতে। ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছি।
চিরিমিরি, সে তো মধ্য প্রদেশে। সেখানে কি করা হয়?
রেলওয়েতে চাকরি করি। ছুটি নিয়ে কলকাতায় আসার অন্যতম উদ্দেশ্য আপনাকে একবার দেখা।
আবার সেই অস্বস্তিকর উক্তি। কথা অন্যদিকে ঘেরাবার জন্যে বললাম—
চিরিমিরিতে শুনেছি অনেক বাঙালী আছে।
তা আছে। প্রায় দুশ ঘর বাঙালী। তারা সবাই আপনাদের পত্রিকা আগ্রহের সঙ্গে পড়েন, আমিও আপনাদের পত্রিকার একজন ভক্ত পাঠক। তাই আপনাকে–
তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম—শুনেছি চিরিমিরির স্বাস্থ্য ভাল। বিশেষ করে ওখানকার জল অজীর্ণ রোগের পক্ষে খুবই উপকারী। আপনার কি মনে হয়?
তা স্বাস্থ্য ওখানে ভালই হয়। আগে ছিলাম বিলাসপুরে। সেখান থেকে বদলি হয়ে চিরিমিরিতে এসেছি আজ মাস দেড়েক হল। আমার নিজেরই স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হয়েছে।
ইতিমধ্যে গাল্পিক-সাহিত্যিক নস্যি কিনে এনে স্বস্থানে বসে পত্রিকার পাতা ওটাতে লাগলেন। যুবকটির ওঠার নাম নেই, তাকিয়েই আছে। অপর পক্ষের তরফ থেকে যদি কোন প্রশ্নই না থাকে তখন জলবায়ু আর খাওয়াদাওয়ার আলোচনা ছাড়া আর কি করা যায়। তার প্রয়োজন যদি ফুরিয়ে থাকে—অর্থাৎ আমাকে দেখার প্রয়োজন—তাহলে এখন বিদায় নেওয়াই উচিত। কিন্তু সে কথা তাঁকে জানাই কি প্রকারে। অগত্যা অসমাপ্ত চিঠির কাগজটা টেনে নিয়ে টেবিলের উপর ঝুকে পড়লাম, যেন কত জরুরী চিঠি এই মুহূর্তে শেষ করে ডাকে না দিলেই নয়। গাল্পিক-সাহিত্যিক ততক্ষণে পত্রিকার পৃষ্ঠায় মুখ ঢেকেছেন।
কোন ফল হল না। যুবকটি যেমন বসেছিল বসেই আছে। মিনিট দুই নীরবতার পর মনে হল এ-কী শাস্তি। আর থাকতে পারলাম না। ভদ্রতার মুখোশ খুলে ফেলে সোজাসুজি তাকে বললাম-আপনার যদি সত্যই আমার কাছে কিছুই বলবার না থাকে তা হলে–
কথাটা শেষ করলাম না, ওটুকু উহ্য রেখে আবার চিঠির কাগজে মনোনিবেশ করলাম। বৃথা চেষ্টা। ব্যঞ্জনায় যে যুবকের কিছুমাত্র বুৎপত্তি নেই তার পরিচয় পেলাম ওর উঠে পড়ার কোন লক্ষণ না দেখে। বাধ্য হয়েই তখন অসমাপ্ত চিঠির প্যাডটা দেরাজের ভিতরে রেখে গাল্পিক সাহিত্যিককে বললাম
আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। কেউ যখন আজ আর আসছে না তখন উঠে পড়াই ভাল।
ছোকরা অমরকে টেবিলের কাগজপত্র তুলে রাখতে বলে কলম পেন্সিল দেরাজে ভরছি, এমন সময়ে যুবকটি একটু ইতস্তত করে বললে–
আপনি কি চলে যাচ্ছেন?
হায়রে! চেয়ে দেখার সাধ কি এখনও মিটলো না? আরও কিছুকাল নীরবে বসে থাকতে হবে? ইলাস্টিক রবারের মত ধৈর্যকে টেনে অনেক লম্বা করা গিয়েছে। এবার ছিড়ে যাবার উপক্রম। কোন রকমে উষ্ম চেপে রেখেই বললাম—
এখনও যদি আপনার বলবার কথা থাকে বলুন, না থাকলে বিদায় নিতে অনুমতি দিন।
কথাটা বলার মধ্যে বোধ হয় একটু রূঢ়তাই প্রকাশ হয়ে থাকবে, তার জন্যে মনে মনে অনুশোচনাও যে জাগে নি তা নয়। আমার এক সাংবাদিক গুরু আমাকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন যে, সম্পাদকের দপ্তর সব সময় আগন্তুকের কাছে অবারিত-দ্বার থাকবে। পত্রিকার যে গ্রাহক বা পাঠক সে সব সময়েই মনে করে এ কাগজ তার নিজের। পত্রিকার দপ্তরে অবাধ যাওয়া-আসার অধিকার তার আছেই, যেমন নিজের বাড়িতে থাকে। কোন লেখক বা পাঠক দপ্তরে এলে, যত ব্যস্ততার কাজই হাতে থাকুক না কেন, দুই হাতে তা সরিয়ে রেখে এমন ভাবে অভ্যর্থনা করবে যেন তুমি এতক্ষণ ওঁরই শুভাগমনের প্রতীক্ষায় বসে আছ। এতকাল গুরুর উপদেশ যথাসাধ্য পালন কররার চেষ্টা করে এসেছি, আজই প্রথম ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিতে লাগলাম। এমন একজন ভক্ত সামনে উপস্থিত, যে সুদূর মধ্য প্রদেশ থেকে এসেছে শুধু আমাকে দেখবার জন্যই, আর কোন প্রত্যাশা তার নেই। এতে পুলকিত হয়ে ওঠবার কথা। আমার মধ্যেও সে-দুর্বলতা নেই তা নয়। তবু শনিবারের আড্ডার প্রাক্কালে এমন একজন অপরিচিত ভক্তের আগমনে উল্লসিত হতে পারি নি। সেই কারণেই বোধ হয় আমার কথায় খানিকটা অসহিষ্ণুতা ফুটে উঠেছিল।