আইষমান গর্ব করে বলেছিলেন, সব কটা ক ক-তে মিলে সবসুদ্ধ পঞ্চাশ লক্ষ প্রাণী খতম করা হয়। হয়ে স্বীকার করেছেন, শত চেষ্টা সত্ত্বেও লাশ নিশ্চিহ্ন করার কাজটা গোপন রাখা যায়নি। অর্থাৎ গ্যাস চেম্বারের নিধনকর্মটি গোপন রাখা যায় কিন্তু মাটিতেই পেতো আর পুড়িয়েই ফেল– সেটা কিন্তু গোপন রাখা যায় না। লাশ-পোড়ানোর তীব্র উৎকট গন্ধ, আর চিমনির চোঙা থেকে যে ধুয়ো বেরুচ্ছে তার ছাই ছড়িয়ে পড়ত কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত চতুর্দিকের গ্রামে। তারা বুঝে যেত ওই নিরীহ স্নান-প্রতিষ্ঠান কোন বিশ্বপ্রেমের খয়রাতি রাজকার্যে লিপ্ত আছেন এবং শুধু সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করত বাতাস যেন তাদের আপন বসগ্রামের দিকে না যায়! এটা কিছু নতুন নয়। যুদ্ধের গোড়াতেই এই নিধনযজ্ঞ হিটলার আরম্ভ করেন জর্মনির পাগলাগারদগুলো দিয়ে পাগলদের ভেতর অবশ্য কিছু ইহুদিও ছিল, কিন্তু অধিকাংশই খাঁটি জর্মন। নামকা ওয়াস্তে একটা কমিশন বসল– এতে অল্পসংখ্যক পাগল রেহাই পেল, যদি আদৌ কেউ পেয়ে থাকে, যে সেটার কোনও উল্লেখ পর্যন্ত নেই– এবং পাগলদের কতকগুলো কেন্দ্রে জড় করে গ্যাস মারফত মেরে ফেলে পুড়িয়ে দেওয়া হল। এটা স্রেফ খুন। জর্মন আইনে নিকটতম তিনজন আত্মীয়ের অনুমতি ভিন্ন পাগলকে এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে সরানো পর্যন্ত যায় না– নিধন করার (যাকে ভদ্রভাষায় বলা হয় মারসি কিলিং= অন্তত যন্ত্রণা থেকে রেহাই দেবার জন্য দয়াবশত কাউকে হত্যা করা, কিংবা অনারোগ্য ক্যানসারের অসহ্য যন্ত্রণায় রুগী যখন বিষ খেতে চায় তাকে বিষ এনে দেওয়া। ডাক্তারি আইনে একে বলা হয়– Euthanasia, গ্রিক সমাস) তো কোনও কথাই ওঠে না। পাগলদের মেরে পুড়িয়ে ফেলার প্রধান কেন্দ্র ছিল হাডামার নামক গ্রামে। তারই পাশে লিম্বুর শহর। সেখানকার বিশপ জর্মনির আইনমন্ত্রীকে একখানা চিঠিতে জানান, স্কুলের ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত সেই বন্ধ বাসগুলো চেনে, যার ভিতরে করে পাগলদের হাডামারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এর কোনও একটাকে দেখলেই ছেলেরা বলে ওঠে– ওই যাচ্ছে খুনের বাস= মারডার বক্স। তাচ্ছিল্যভরে কথায় একে অন্যকে বলে ক্ষেপলি নাকি?– যাবি নাকি হাডামারের বেকিং বসে (যাতে কেক বানানো হয়; এস্থলে লাশ পোড়াবার চুল্লি?) হাডামারের চিমনি ছাড়ে ধুয়ো আর সেখানকার অধিবাসীরা are tortured with the ever-present thought of depending on the direction of the wind. 099 কথা সত্য এ-সব খুন-খারাবি, লাশ পোড়ানোর খবর দেশময় ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। যারা জানত, তারা জানত। অন্য কাউকে বলতে গিয়ে কেউ গেস্তাপোর (গোপন পুলিশ–এদের প্রধানতম কর্ম ছিল রাজনৈতিক, অনেকটা রুশের ওগপুর মতো– এদের কাহিনী ক ক-র চেয়েও বীভৎসতর) হাতে ধরা পড়লে প্রথমে তার ওপর কল্পনাতীত নানা অত্যাচার এবং এতেও যদি সে না মরে তবে সর্বশেষে তাকে কোনও একটা ক ক-তে সমর্পণ এবং সেখানে গ্যাস-চেম্বারে মৃত্যু। কাজেই হাডামার বা ক ক-গুলোতে কী হচ্ছে সে সম্বন্ধে মুখ খুলে কেউ রা-টি কাড়ত না! তাই ওই আমলে একটা চুটকিলা রসিকতা সৃষ্ট হয়–
তুই নাকি, ভাই, ডেনটিসটরি পড়া ছেড়ে দিয়েছিস?
বাধ্য হয়ে ছাড়তে হল। কেউ যে মুখ খুলতে রাজি হয় না।
লিমবুরগ-এর বিশপের চিঠি পেয়ে আইনমন্ত্রী হিটলারের আপন আইন উপদেষ্টার কাছে এ বাবদে অনুসন্ধান করলেন। আইন-উপদেষ্টা হিটলারের সেই চিঠি দেখালেন। আইনমন্ত্রী বললেন, এটা তো তাঁর নির্দেশ। এটা তো আইন নয়। আপনারা তা হলে এটাকে আইনের রূপ দিন, সেটাকে তার পর দেশে প্রবর্তিত করুন।…তা হলেই তো চিত্তির! কারণ, জর্মন পার্লিমেন্ট আইন করার সক্ষমতা সর্ব অধিকার হিটলারকে দিয়েছিল বটে, কিন্তু আইন মাত্রই সরকারি গেজেটে প্রকাশ করতে হয়। তার পর এক বছর কেটে গেল, আইনমন্ত্রী কোনও উত্তর পেলেন না। ইতোমধ্যে দেশের সব পাগল খতম। সমস্যাটার সুচারু সমাধান হয়ে গেল আপসে আপ। কোনও কোনও দেশে যেরকম দুর্ভিক্ষের সমস্যা আপৃসে আপ সমাধান হয়ে যায় কয়েক লক্ষ লোক না খেয়ে মরে যাওয়ার পর।
লাখ তিরিশ বা পঞ্চাশেক ইহুদিকে যে ওপারে পাঠানো হল তার জন্যও কোনও আইন বিধিবদ্ধভাবে তৈরি করা হয়নি। কিন্তু সে মামলা নিয়ে কখনও কোনও লেখালেখি হয়নি,– ফরিয়াদ করবে কে?– হলেও সেটা লোকচক্ষুগোচর হয়নি। পবিত্র পিতা পোপের কাছে কোনও নিধনই অজানা ছিল না। তিনি থেকে থেকে বিশ্বজন তথা সুস্পষ্ট ইঙ্গিতে হিটলারের কাছে এপিল করতেন ক্রিসটিয়ান চ্যারিটি দেখবার জন্য। এর বেশি তিনি কিছু করে উঠতে পারেননি। (৭)
হিটলার ক ক-তে কত লক্ষ ইহুদি, রুশ, বেদে ইত্যাদিকে নিহত করেন সেই সংখ্যা নিয়ে যখন নরবের্গ মোকদ্দমায় তুমুল তর্কাতর্কি হচ্ছে তখন আসামিদের একজন ছিলেন ফ্রান্। (এরই আদেশে অসংখ্য ইহুদিকে আইষমানের হাতে সমর্পণ করা হয় এবং বিচারে এঁর ফাঁসি হয়। ওই বিচারে উনিই একমাত্র আসামি যিনি নিজেকে দোষী বলে স্বীকার করেন)। সেই তর্কাতর্কির ভেতর আসামিদের কাঠগড়ার পিছনে যে মার্কিন সান্ত্রি দাঁড়িয়ে ছিল সে শুনতে পেল (যে সব মার্কিন জোয়ান উত্তম জর্মন জানত তাদেরই এ কাজে নিয়োজিত করা হত এবং এরা ভাবখানা করত যেন জর্মন বিলকুল বোঝে না– ফলে আসামিরা নিজেদের ভিতরে এমন সব কথা বলে ফেলত যেগুলো সান্ত্রিরা ফরিয়াদি পক্ষের মার্কিন উকিলকে জানিয়ে দিত। আমার মনে হয় এটা অত্যন্ত বে-আইনি ব্যাপার। কিন্তু মার্কিন আইনকানুন যেন শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইনকানুন সর্বনেশে ॥) ফ্রানু ফিসফিস করে তাঁর সহআসামি হিটলারের অন্যতম মন্ত্রী রোজেনবেরককে বলেছেন, এরা—-অর্থাৎ মার্কিনিংরেজসহ মিত্রশক্তি চেষ্টা করেছে আউশভিৎসে দৈনিক যে দু হাজার ইহুদি মারা হত তার কুল্লে গুনাহ্ কালটেন ব্রুনারের ওপর চাপাবার।(৮) কিন্তু ওই যে মার্কিনিংরেজের বোমাবর্ষণের ফলে ঘন্টা দুয়েকের ভেতর হামবুর্গ বন্দরে ত্রিশ হাজার লোক মারা গেল তার কী? এদের বেশিরভাগই তো ছিল শিশু এবং অবলা। তার পর ওই যে জাপানে এটম বম ফেলে আশি হাজার লোক মারা হয় তার কী? এই বুঝি ন্যায়, এই বুঝি ইনসা?