তিন দিন পরেই চিঠি।
১২ গোলাম সিদ্দিক রোড
কলকাতা
সালাম পর আরজ এই,
আপনার ওখানে কীভাবে আমার সময়টা কাটল সেটা আপনি নিজেই দেখেছেন।
আমরা আলোচনা করছিলুম, মুসলমান মেয়েদের নিয়ে, যারা অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে আসছে; বলুন তো, আপনার ওখানে গিয়ে আমি যে-আনন্দ ও বৈভব গনিমত শব্দটা আরও ভালো পেলুম, কটা মুসলমান মেয়ের ভাগ্যে সেটা জোটে? আমরা যে কী গরিব সে তো আপনি জানেন না, কারণ আপনি সমস্ত জীবন কাটিয়েছেন আপনার হিন্দু আত্মজনদের সঙ্গে।
স্বাধীনতা বড় সম্পদ। আমরা, মুসলমান মেয়েরাও ক্রমে ক্রমে স্বাধীন হচ্ছি কিন্তু সে-স্বাধীনতার ফল আস্বাদন করার সুযোগ পাচ্ছি কই? মনে হয়, আমি যেন একাকিনী কোনও নির্জন দ্বীপে বাস করছি; প্যাটরায় লক্ষ টাকা কিন্তু কিনব কী? লোকালয়ে এই লক্ষ টাকা দিয়ে যে কতকিছু করা যায় সেটা না জানা থাকলে ব্যঙ্গটা অতখানি নিষ্ঠুর মনে হত না। এই লক্ষ টাকা বিলিয়ে দিয়েও আমি আনন্দ পেতুম। কিন্তু দেব কাকে?
আপনার ডাক্তার লেবরেটরিতে গেছেন সকাল সাতটায়; তাঁকে ফের পাব রাত আটটায় কপাল যদি মন্দ না হয়!
আপনি আমার বৃহৎ বৃহৎ আদাব তসলিমাৎ জানবেন।
খাকসার
শহর-ইয়ার।
অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চিঠিখানা পড়লুম। এই প্রথম নয়, আগেও ভেবেছি, এ মেয়ের অভাব কোনখানটায়? স্বামী আপন কাজ নিয়ে ব্যস্ত বলে সে তার যথেষ্ট সঙ্গ পায় না–এইটেই দুঃখ? উঁহু, তা নয়। এ মেয়ে গতানুগতিক অর্থে শিক্ষিতা নয়; এ মেয়ে বিদগ্ধা এবং এর কল্পনাশক্তি আছে। দিন-যামিনীর অষ্টপ্রহরের প্রত্যেকটি প্রহর নিঙড়ে নিঙড়ে তার থেকে কী করে আনন্দ-রস বের করতে হয় সে সেটা খুব ভালো করেই জানে। তাকে তাস মেলে পেশেন খেলে দিন কাটাতে হবে না। এ মেয়ে গোপালভাড়, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে। গোপাল ঢেউ গুনে পয়সা কামিয়েছিল। এ মেয়ে ঢেউ গুনে আনন্দের ভাণ্ডার ভরে তুলবে। এবং বাড়ি ফিরে তাই দিয়ে হরিনুট লাগাবে।
আচমকা খেয়াল গেল, কই, আমার কলকাতা যাওয়ার কথা তো কিছু লিখল না? যাকগে– তার জন্য এখনও সময় আছে।
কোন এক পোড়ার বিশ্ববিদ্যালয় তুলনাত্মক ধর্মতত্ত্ব প্রবর্তন করতে চায়। আমাকে অনুরোধ করছে প্ল্যানটা করে দিতে। সাধারণ অবস্থায় এসব বুনো হাঁস খেদাতে আমি তো রাজিই হই না, উল্টো কয়েকটি সরল প্রাঞ্জল বাক্যে এমনসব আপত্তি উত্থাপন করি যে, তারা প্ল্যানটার আঁতুড়ঘরে তার গলায় নুন ঠেসে দেয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সে পথ বন্ধ। পোশাকি সরকারি চিঠির এক কোণে আমার বন্ধু– সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চেনূসেলর– ক্ষুদে ক্ষুদে হরফে ফরাসিতে লিখেছেন, বাপের সুপুতুরের মতো প্ল্যানটি পাঠিয়ো, নইলে এ শহরের যে-সব পাওনাদারদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলে তাদের প্রত্যেককে তোমার বর্তমান ঠিকানাটি জানিয়ে দেব– উইদ মাই বেস্ট কমপ্লিমেন্ট।
প্ল্যানটা তৈরি করা তো সোজা কিন্তু সিমেন্ট কই, লোহা কোথায়? অর্থাৎ এই পবিত্র আর্যভূমিতে যাবনিক ধর্মগুলোর মেটিরিয়েল পাই কোথায়?
তারই যোগাড়যন্ত্রের দুর্ভাবনায় দিনগুলো কোন পথে যে চলে গেল খেয়ালই করিনি। অবশেষে একদা রাত্রে দ্বিপ্রহরে ত্রিশটি পাতার শেষ পাতাটি টাইপ করে ঘুমুতে গেলুম।
মাস্টার বড় ঘেউ ঘেউ করছে– চতুর্দিকে প্রতিরাত্রে চুরি হচ্ছে সে খবর বাবুর্চি আমায় দিয়েছিল কিন্তু এ চোরটা তো একেবারেই রামছাগল। দু দুটো আলসেশিয়ান আমার বাড়িতে। এ দেশটাই মোস্ট ইনকমপিটেন্ট, চোরগুলো পর্যন্ত নিষ্কর্মা– দিনের বেলা একটু খবরাখবর নিলেই তো বুঝতে পারত ভদ্র চোরের পক্ষেই এ বাড়ি ভাদ্রবধূ।
নাহ! উঠতেই হল। মাস্টার ওরকম করছে কেন? বিষাক্ত খাবার দিচ্ছে নাকি কেউ?
দরজা খুলে বারান্দার আলো জ্বাললুম।
দু বার চোখ কচলালুম। গায়ে চিমটি কাটলে অবশ্য ভালো হতো– স্বপ্নটা তা হলে উপে যেত।
ব্যাকরণে যখন সে ভুল হয়েই গেল তখন স্বীকার করতেই হয় সামনের ডেকচেয়ারে বসে শহর-ইয়ার ঠোঙা থেকে শিককাবাব বের করে করে মাস্টারকে খাওয়াচ্ছেন। আমাকে দেখে তাচ্ছিল্যভরে বললেন, আপনি আবার উঠলেন কেন?
আমি বললুম, বেশ, শুতে যাচ্ছি। শুধু একটা কথা শুধোই, শ্মশানের কাছে এসে টাঙার পথ যেখানে শেষ হয় সেখান থেকে আপনি এলেন কী করে? তার পর তো পথ নেই, অন্ধকার
ও। রিকশাওয়ালা খানিকটে পথ এসেছিল। আমি বিদেয় করে দিলুম। ব্যাগটা তো ভারী নয়।
রবীন্দ্রনাথের মতো কবি পরিপকু বয়সে তাঁর যত অভিজ্ঞতা, অন্যের হৃদয়ে তার অনুভূতি সঞ্চারণ করার যত দক্ষতা, তার সম্মোহিনী ভাষা অলঙ্কারধ্বনি সর্বস্ব প্রয়োগ করে একটি দীর্ঘ কবিতার মাঝখানে এসে থমকে দাঁড়িয়ে, যেন হার মেনে বলছেন, দুটি শব্দ–
বৃথা বাক্য।
যামিনীর তৃতীয় যামে, জীবনেরও তৃতীয় যামে অর্থাৎ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গুরুবদননিঃসৃত এই আপ্তবাক্যটি পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করলুম। চুপ করে বসে থাকা ভিন্ন গতি কী?
মাস্টারকে খাওয়ানো শেষ হলে বাথরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে এসে, ঘোমটা টেনে আগের চেয়ে আরও বিনয় সেলাম করল।
পাশে চেয়ার এনে বসে বললে, আজ আর চাঁদ উঠবে না। না?
আমি বললুম, আজ শুক্লা-পঞ্চমী। চন্দ্র অনেকক্ষণ হল অস্ত গেছে। আচ্ছা আমি শুধু আপনাকে একটি প্রশ্ন শুধাব। এ আসাটা কীভাবে হল?