শহর-ইয়ার বানু দেখলুম অনেক চিন্তা করে রেখেছেন। বললেন, সতীদাহ বন্ধ। করাটা হিন্দুকে মেনে নিতে হয়েছে, নইলে সাজা পেতে হয়। কিন্তু যেখানে বাছাই করার স্বাধীনতা রয়েছে সেখানে হিন্দু নারী কোনটা বরণ করেছে? এ যাবৎ কটা বিধবাবিবাহ হয়েছে।
আমি বললুম, মুসলমান মেয়েদের ভিতরই-বা কটা হয়? কিংবা ধরুন তালাক। এদেশের মুসলমান ভদ্রসমাজে কি আরবিস্তানের আধার আধারও তালাক হয়?
শহর-ইয়ার বললেন, আরবিস্তানে তালাক দেয় পুরুষে– মেয়েদের তালাক দেবার অধিকার এতই সীমাবদ্ধ যে, সে-অধিকার আদপেই নেই বললে চলে। আমি মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা তুলছি– যেমন বিধবাবিবাহ। প্রশ্ন উঠবে, আরও অধিক সংখ্যক মুসলিম বাল-বিধবা বিয়ে করল না কেন?
আসলে কী জানেন, পরাধীন অবস্থায় মানুষে মানুষে পার্থক্য কমতে থাকে; স্বাধীন অবস্থায় মানুষের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ফুটে বেরোয়। অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য নানা কারণে এদেশের হিন্দু-মুসলমান রমণী উভয়ই ছিল স্বাধীনতালুপ্ত হারেমবদ্ধ (বরঞ্চ আফগানিস্থান, ইরান-আরবের মেয়েরা বোরকা পরে রাস্তায় বেরোয়, আত্মীয়স্বজনের মোলাকাত করে এমনকি বাজার-হাটেও যায়– এদেশে সে ব্যবস্থাও ছিল না। তাই আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় দুই-ই এক। এই যে আপনার ড্রইংরুম এর ভিতর ডার্বি ঘোড়া এবং ছ্যাকড়া গাড়ির ঘোড়াকে ছেড়ে দিলে দু জনাই ছুটবে মোটামুটি একই বেগে। কিন্তু ছেড়ে দিন আপনার বাড়ির সামনের খোলা মাঠে। তখন কোথায় ডার্বি, আর কোথায় ছ্যাকড়া! যার যার ভিতরকার সুপ্ত বৈশিষ্ট্য তখন পরিপূর্ণ মাত্রায় চোখের সামনে জাজ্বল্যমান হয়।
অন্দর মহল থেকে বেরিয়ে আসুক হিন্দু-মুসলমান দুই নারীই; তখন দেখতে পাবেন তাদের পার্থক্য কোন জায়গায়।
আবার বলছি, কসম আল্লার, আমি আদৌ বলছি না, মুসলমান মেয়ে হিন্দু মেয়ের চেয়ে সুপেরিয়র; আমি বলছি, সে ডিফরেন্ট।
এমন সময় দুটো তালগাছের মাঝখান দিয়ে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ একটা গাছের উপর ঈষৎ হেলান দিয়ে আকাশের পূর্বপ্রান্ত আলোকিত করে দিলেন।
শহর-ইয়ার বললে, আহ! বড় সুন্দর এ জায়গাটা। অতএব এখন থাক নারী-সমস্যা!
চুপ করে তাকিয়ে আছি লবাবুর বাড়ির পরিত্যক্ত ভিটে ছাড়িয়ে, রেললাইন পেরিয়ে তালসারির দিকে। বার বার এ দৃশ্য দেখেও আমি তৃপ্ত হইনে, কিন্তু এ-ও সত্য শহর ইয়ারের আনন্দ তার এখানে আসা অবধি প্রত্যেক আনন্দ ছাড়িয়ে যায়। চুপ করে আছে বটে কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল তার সর্বাঙ্গ থেকে যেন সে-আনন্দ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল।
ঘোরঘুট্টি অন্ধকার দূর করতে করতে চাঁদ আর কিছুক্ষণ পরেই তার জ্যোতিঃশক্তির শেষ সীমানায় পৌঁছবেন– এর পর রাতভর যে আলো সেই আলোই থাকবে। আমি শহর-ইয়ারকে বললুম, পূর্ণিমা চাঁদের যেন বড় দেমাক, অন্তত এর তুলনায়। আচ্ছা, একবার ডাক্তারকে ডেকে দেখালে হয় না?
বললে, নিশ্চয়ই, কিন্তু কী জানেন, উনি নিজেই বলেন, এসব দৃশ্যের সৌন্দর্য তিনি বুঝতে পারেন কিন্তু সেটা তাঁর হৃদয় স্পর্শ করে না। ওদিকে অসম্ভব ভদ্রলোক বলে আমরা যতক্ষণ চাই তিনি আমাদের সঙ্গ দেবেন এবং বিশ্বাস করবেন না, সানন্দে। এবং তাতে কণামাত্র ভণ্ডামি নেই। ঠিক সেইরকম শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। দরকার হলে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে সংগীতের সূক্ষ্মতম তত্ত্ব নিয়ে বড় বড় সঙ্গীতজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। কারণ সমস্ত সংগীতশাস্ত্র তিনি কঠোর কঠিন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আয়ত্ত করেছেন। জানেন, একবার একটি অজানা অচেনা তরুণ গাওয়াইয়াকে এক জলসায় গোটাকয়েক দম্ভী অযথা আক্রমণ করে- ঘরানা ঘরানায় আড়াআড়ি তো এদেশে একটা কেলেঙ্কারির ব্যাপার। কেন জানিনে, উনি গেলেন ক্ষেপে অবশ্য বাইরে তার কণামাত্র প্রকাশ তিনি হতে দেননি, কখনও দেন না, একমাত্র আমিই শুধু বুঝতে পেরেছিলুম এবং তার পর সে-কী তর্কযুদ্ধ! শুধু যে সেই তরুণের ন্যায্য প্রাপ্য সম্মান প্রমাণ করে দিলেন তাই নয়, তার বিরুদ্ধপক্ষের মহারথীদের সঙ্গীতশাস্ত্রজ্ঞান সম্বন্ধে নিরপেক্ষ পাঁচজনের মনে গভীর সন্দেহ জাগিয়ে বাড়ি ফিরলেন। অথচ তিনি আমাকে বহুবার বলেছেন, সঙ্গীত তাঁর হৃদয় স্পর্শ করে না! কী জানি, হয়তো ডাক্তারি শেখার পূর্বে রসগ্রহণ করার ব্লটিং পেপারখানা করকরে শুকনোই ছিল; এখন সেটা চিকিৎসা-জ্ঞানে জবজব।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, কী জানি! আমার প্রতি তার ভালোবাসাটাও বোধ হয় ওই ধরনের! তবে কি না, বিয়ের দশ বছর পরে, এই ত্রিশ বছর বয়সে এটা নিয়ে চিন্তা করা বেকার!
হঠাৎ উঠে বললেন, এবারে শুতে যাই। যে ঘরখানা আমায় দিয়েছেন তার জানালা দিয়ে মেটার্নেল আনকল মি. মুনের সঙ্গে মনে মনে রসালাপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু তার পূর্বে একখানা শেষ রেকর্ড বাজাব। বলুন, কী বাজাব?
আমি চিন্তা না করেই বললুম, কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশ-কুসুম চয়নে।
.
০৪.
পরের দিন ওরা চলে যাওয়ার সময় আমাকে দিয়ে যে শুধু কলকাতা আসার প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল তাই নয়, শহর-ইয়ার পাকা মহকুমা মোক্তারের মতো ক্ৰস্ এগজামিনেশন করে করে একেবারে তারিখ এমনকি কোন ট্রেন ধরতে হবে সেটা পর্যন্ত ঠিক করে দিয়ে গেল। একাধিকবার বললে, এখানে তো দেখে গেলুম, আপনি কীভাবে থাকেন, আমাদের ওখানে সেভাবেই ব্যবস্থা করব। আপনার খুব অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না।