হায় আল্লাতালা! আমাকে তুমি এ কী নির্দেশ দিলে যার জন্য আমার এই প্রাণপ্রিয় স্বামী, আমার মালিককে ছেড়ে যেতে হচ্ছে! সৈয়দ সাহেব, আমি জানি আর আমার স্বামী জানেন, আমাদের আজও মনে হয়, আমাদের বিয়ে যেন সবেমাত্র কয়েকদিন আগে হয়েছে। আমরা যেন এইমাত্র বাজগতি (বাঙলায় কী বলে? দ্বিরাগমন?) সেরে স্টিমারের কেবিনে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একে অন্যকে চিনে নিচ্ছি। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, আমি কী ভাগ্যবান! লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। মাথায় ঘোমটা টেনে তার পদস্পর্শ করে বললুম, আপনি এ কী করলেন? আমি যে এখনই এই কথাটিই বলতে যাচ্ছিলুম।
তিনি হো হো করে হেসে উঠে বলেছিলেন, পাগলী!
ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। আজ প্রমাণ হতে চলল, আমি পাগলিনী। নইলে আমি আমার এমন মনিব ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছি কেন?
কত বলব? এর যে শেষ নেই।
***
আপনাকে ছেড়ে যেতে আমার নিজের জন্য কষ্ট হয় আপনি কতখানি বেদনা পাবেন, সে-কথা আমি ভাবছিনে। যাবার বেলা শেষ একটি কথা বলি। যবে থেকে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় (আল্লা সে-দিনটিকে রোশূনিময় করুন!) তখন থেকেই লক্ষ করেছি, আপনার ভক্ত-চেলার সংখ্যা খুব নগণ্য নয়। হয়তো আপনার চেয়ে কাঁচা লেখকের ভক্তের সংখ্যা আরও বেশি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করে আমি আশ্চর্য হয়েছিলুম এবং অতিশয় পুলকিত হয়েছিলুম। আপনার ভক্তা নেই, আপনার কোনও রমণী উপাসিকা নেই। আমিই তখন হলুম আপনার অদ্বিতীয়া সখী, নমসহচরী– যে নামে ডাকতে চান, ডাকুন। এ হেন গৌরবের আসন ত্যাগ করে যেতে চায় কোন মুখী! তবু যেতে হবে।
সর্বশেষে আপনাকে, নিতান্ত আপনাকে একটি কথা বলি :
ওই যে কবিতা–কবিতা বলা ভুল, এ যেন আপ্তবাক্য রূপনারাণের কোলে/ জেগে উঠিলাম-এর শেষ দুটি লাইনকে আমি অকুণ্ঠ স্বীকার দিতে পারছিনে। লাইন দুটি :
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে।
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।
এখানে আমি কুষ্টিয়ার লালনফকিরের আপ্তবাক্য মেনে নিয়েছি। তিনি বলেছেন, এখন আমার দেহ সুস্থ, মন সবল, পঞ্চেন্দ্রিয় সচেতন। এ অবস্থায় যদি আল্লাকে না পাই তবে কি আমি পাব মৃত্যুর পর?– যখন আমার দেহমন প্রাণহীন, অচল অসাড়? আমি সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে মৃত্যু দিয়ে সকল দেনা শোধ করব না।
আমার যা পাবার সে আমি এই জীবনেই, জীবন্ত অবস্থাতেই পাব।
খুদা হাফিজ! ফি আমানিল্লা!!
আপনার স্নেহধন্য কনিজ
শহর-ইয়ার
হাত থেকে ঝরঝর করে সবকটি পাতা বারান্দার মেঝেতে পড়ে গেল।
এতক্ষণ আমার (এবং শহর-ইয়ারেরও) আদরের আলসেশিয়ান কুকুর মাস্টার আমার পাশে শুয়ে মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছিল।
এখন হঠাৎ বারান্দার পূর্ব প্রান্তে গিয়ে নিচের দু পায়ের উপর বসে উপরে দু পা আকাশের দিকে তুলে দিয়ে চিৎকার করে ডুকরে ডুকরে আর্তরব ছাড়তে আরম্ভ করল। সম্পূর্ণ অহেতুক, অকারণ।
তবে কি মাস্টার বুঝতে পেরেছে, তার-আমার প্রিয়বিচ্ছেদ। আল্লাই জানেন সে গোপন রহস্য।
***
অবসন্ন মনে মৃত দেহে শয্যা নিলুম। ঘুম আসছে না।
দুপুররাত্রে হঠাৎ দেখি মাস্টার বিদ্যুৎবেগে নালার দিকে ছুটে চলেছে। হয়তো শেয়ালের গন্ধ পেয়েছে।
তার খানিকক্ষণ পরে ওই দুপুররাত্রে কে যেন বারান্দায় উঠল। উঠুক। আমার এমন কিছু নেই যা চুরি যেতে পারে।
হঠাৎ শুনি ডাক্তারের গলা। আমার কামরার ভিতরেই।
এক লক্ষে দাঁড়িয়ে উঠে তাকে আলিঙ্গন করলুম। বাতি জ্বাললুম।
এ কী! আমি ভেবেছিলাম তাকে পাব অর্ধ-উন্মত্ত অবস্থায়। দেখি, লোকটার মুখে তিন পোচ আনন্দের পলেস্তরা।
কোনও প্রকারের ভূমিকা না দিয়ে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বললে,
নাম্বার ওয়ান : আমাদের বসতবাড়ি পরশুদিন পুড়ে ছাই।
নাম্বার টু : আমরা আগামীকাল যাচ্ছি সুইডেনে। আমার রিসার্চের কাজ সেইখানেই ভালো হবে।
নাম্বার থ্রি : (কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন) শহর-ইয়ার অন্তঃসত্ত্বা।
নাম্বার ফোর :–
আমি বাধা দিয়ে বললুম, সে কোথায়?
বারান্দায়। মাস্টারকে খাওয়াচ্ছে।
***
বারান্দায় এসে শহর-ইয়ারকে বললুম, সুইডেনে তুমি নির্জনতা পাবে।
তার পর শুধালুম, আবার দেখা হবে তো?
সে তার ডান হাত তুলে দেখি, আমি তাকে ঢাকা থেকে এনে যে শাখার কাকন দিয়েছিলুম সেইটে পরেছে সে-হাত তুলে আস্তে আস্তে ক্ষীণকণ্ঠে বললে, কী জানি, কী হবে।
*** আমার এক বন্ধু রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুশয্যায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন। তিনি আমাকে বলেন, রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর পূর্বে তার দুর্বল হাত তুলে বলেন তখন তার চৈতন্য ছিল কি না জানিনে কী জানি, কী হবে।