কারণ আমি যখন আমার রূপনারাণের তীরে পৌঁছলুম, রূঢ়তমরূপে আমার নিদ্রাভঙ্গের দ্বিজত্বের সম্মুখীন হলুম তখন শুধু যে আমার পূর্ববর্ণিত
ট্র্যাডিশন। ট্র্যাডিশন!!
ট্র্যাডিশনের পাষাণপ্রাচীর নির্মিত অচলায়তন দেখতে পেলুম, তাই নয়।
আতঙ্ক, বিস্ময়, এমনকি নৈরাশ্যে প্রায় জীবনূতাবস্থায় আমি আরও অনেক অন্ধপ্রাচীর, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের চতুর্দিকে যেরকম চার দফে ইলেকট্রিফাইড লোহার কাঁটাজাল থাকে সেগুলোও দেখতে পেলুম।
এবং তার চেয়েও মারাত্মক বিভীষিকাময় : ভুল আদর্শ, ভুল মরালিটি, বেকার পরোপকার, মহাশূন্যে দোদুল্যমান আলোকলতার উপর স্তরে স্তরে ফুটে-ওঠা সঙ্গীতের ক্ষণস্থায়ী আকাশকুসুম, কবি বায়রনের ভাষায়–
এ যেন জীর্ণ প্রাসাদ ঘেরিয়া
শ্যামা লতিকার শোভা,
নিকটে ধূসর জর্জর অতি
দূর হতে মনোলোভা।
আর কী সব ভুল দেখেছিলুম তার ফিরিস্তি আপনাকে দিতে গেলে পুরো একখানা মোহাম্মদি পঞ্জিকা লিখতে হবে। এককথায় দেহের ভুল, হৃদয়ের ভুল, মনের ভুল পঞ্চেন্দ্রিয়ের ভুল। অর্থাৎ কিশোরী অবস্থা থেকেই শুরু করেছি ভুল এবং চলেছি ভুল পথে।
আমি নিরাশাবাদী নই, অতএব ঢেলে সাজাতে হবে নতুন করে। জীবনের সঙ্গে রিটানম্যাচের এখনও সময় আছে– প্রস্তুতি করবার।
***
কিন্তু পন্থা কী?
শিশু যেমন মায়ের হাতে মার খেয়ে মায়ের কোলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমি তেমনি রূপনারাণের কূলে নয় রূপনারায়ণের কোলে আছাড় খেয়ে পড়লাম।
বিশ্বরূপের অতিশয় রূঢ় প্রকাশ এই পৃথিবীতে আমরা যাকে সৌন্দর্য বলি, তার সঙ্গে আমার কিছুটা পরিচয় ছিল। অতিক্ষুদ্র কীট ও তার জীবনস্পন্দনে অন্তহীন গ্রহ-সূর্য-তারায়-তারায় যে জীবনস্পন্দন আছে তার লক্ষাক্ষৌহিণী অংশ যতখানি অন্ধভাবে অনুভব করে, ঠিক ওই অতি অল্পখানি। সেই-ই প্রচুর। পর্যাপ্তরও প্রচুরতর অপর্যাপ্ত! আরব্য রজনীর অন-নশার একঝুড়ি ডিম দিয়ে কারবার আরম্ভ করে উজিরবানুকে বিয়ে করবার প্ল্যান কষেছিল। তার হিসাবে রত্তিভর ভুল ছিল না– ভুল ছিল তার হঠকারিতায়। আর আমার হাতে তো কুল্লে সর্বসাকুল্যে মাত্র একটি ডিম। কার্ডিনাল নিউম্যান কী গেয়েছিলেন– স্মৃতিদৌর্বল্যের জন্য ক্ষমাভিক্ষা করছি আমি তো যাত্রা-শেষের দূরদিগন্তের কাম্যভূমি দেখতে চাইনে; আমাকে, প্রভু; একটি পা ফেলার মতো আলো দেখাও। আই ডু নট ইয়োন্ট টু সি দ্য ডিসটেন্ট সিন! ওয়ান স্টেপ ইনাহ্ ফর মি। তাই আমি বিশ্বরূপ লতিফের সন্ধানে বেরোলুম।
এরপর আমার যেসব নব নব অভিজ্ঞতা হল তার বর্ণনা দেবার ভাষা আমার নেই, কখনও হবে না, কারণ আমি তাপসী রাবেয়া নই। আমি সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা দেখছি। তাই আপনি আমার চোখ কেমন যেন কুয়াশাভরা ফিলমে-ঢাকা দেখেছিলেন।
অতএব অতি সংক্ষেপে সারছি।
প্রথমেই আপনার কথা মনে পড়েছিল। কিন্তু চিন্তা করে দেখলুম, আপনি স্বপ্নমগ্ন না হলেও রূপনারাণের তীরে আপনি এখনও পৌঁছননি। প্রার্থনা করি, কখনও যেন না পৌঁছতে হয়।
সবাইকে যে পৌঁছতে হবে এমন কার, কোন মাথার দিব্যি? যদি রূপনারাণে পৌঁছতেই হয় তবে যেন পৌঁছেন আপনার শুরুরই মতো আশি বছর বয়সে। আমার কপাল মন্দ (মুনিঋষিরা হয়তো বলবেন ভাগ্যবন্ত আমি অখণ্ডসৌভাগ্যবতী), আমি যৌবনেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছি। কোনও ইয়োরোপীয় বিলাসরভসে নিমজ্জিত এক ধনীর সন্তান যৌবনে বলেছিলেন স্যালভেশন, মুক্তি, মোক্ষ? নিশ্চয়ই চাই, প্রভু। কিন্তু not just yet অর্থাৎ একটু পরে হলে হয় না, প্রভু? আমার বিলাসবাসনা তেমন কিছু একটা নেই, কিন্তু আমার যে ভয় করে।… আপনার কাছে যাওয়া হল না।
তখন পেলুম পীর সাহেবকে। আমার বড় আনন্দ, আপনি তাকে ভুল বোঝেননি। তিনি কখনও আদৌ আমার ওপর কোনও প্রভাব বিস্তার করতে চাননি। বরঞ্চ তিনি যেন হলেন এমবারাসট– যেন একটা ধন্ধে পড়লেন। বুঝে গেলুম, তাঁর যেন মনে হয়, যৌবনের কাম-বাসনা ইত্যাদি খানিকটে পুড়িয়ে নিয়ে তার পর ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে নামা প্রশস্ততর।
***
আপনি জানেন, যদিও ধর্মেকর্মে আমার আসক্তি ছিল সামান্যই, তবু আমি শ্রীঅরবিন্দের আধা-ধর্ম-আ-কালচারাল লেখাগুলো সবসময়ই মন দিয়ে পড়েছি। বুঝেছি অবশ্য সিকি পরিমাণ। তাঁর কথা আমার মনে পড়ল সর্বশেষে। কৃপণ যে-রকম তার শেষ মোহরটির কথা স্মরণ করে সব খতম হয়ে যাওয়ার পর।
তার সে-লেখাটির নাম বোধ হয় উত্তরপাড়া ভাষণ।
আলিপুরের বোমার মামলা তখন সবে শেষ হয়েছে। সমস্ত বাঙলা দেশ উদগ্রীব, এবারে শ্রীঅরবিন্দ বাঙলা দেশকে কোন পথে নিয়ে যাবেন। আর বাঙলা দেশের সঙ্গে বিজড়িত রয়েছে সমস্ত ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ।
কী গুরুতর দায়িত্ব! মাত্র একটি লোকের স্কন্ধে!
তখন তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার মূল কথা একটি বাক্যে বলা যেতে পারে– তিনি আপন ভবিষ্যৎ কর্তব্য সম্বন্ধে কিছুদিনের জন্য নির্জনে চিন্তা করতে চান।
আর আমি তো সামান্য প্রাণী। আমার এ ছাড়া অন্য কোনও গতি আর আছে কি?
আমি খুব ভালো করেই জানি, আমার স্বামীর অত্যন্ত কষ্ট হবে। এরকম ফেরেশতার মতো স্বামী কটা মেয়ে পায়! তাই জানি, যখন তাঁর কাছ থেকে বিদায়ের অনুমতি চাইব তিনি আমাকে বাধা দেবেন না। তিনি নিজে ধার্মিক–তাই বলে যে তিনি আমার ধর্মজীবনের অভিযানে বাধা দেবেন না, তা নয়। আমি যে দিনের পর দিন বাড়িতে বসে বসে ঝুরে মরব সেটা তিনি কিছুতেই সইতে পারবেন না।