এইবারে মোদ্দা কথা বলি। সেই রাখাল ছেলের বন্ধুর পিতা বাদশা তাঁর সমাধিসৌধের প্রস্তর ভেঙে ভেঙে উঠতে যত না হিমসিম খাবেন, তার সঙ্গে আমার এই উকট সঙ্কটের কোনও তুলনাই হয় না। জ্যান্ত গোরের মানুষ আপন ছটফটানিতে নিরুদ্ধ-নিশ্বাস হয়ে প্রাণবায়ু ত্যাগ করে।
তথাপি আমি ওই খানদানি পাষাণদুর্গে থাকতে চাইনি। ঠিক মনে নেই, তবে গল্পটি খুবসম্ভব সার্থকা সাহিত্যিকা শ্রীযুক্তা আশাপূর্ণা দেবীর; একটি বালিকা স্বাধীনতা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি যুবকের সংস্পর্শে এসে স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শে উদ্দীপ্ত হয়। অহেতুক যোগাযোগের ফলে তার কিন্তু বিয়ে হয়ে গেল এক অতি দুর্ধর্ষ কৃষাণরক্তশোষক জমিদারের ছেলের সঙ্গে। আমার মনে নেই, মেয়েটি হয়তো-বা অনিচ্ছায় বিয়ে করেছিল, কিংবা হয়তো বলদৃপ্ত পদে স্বামীগৃহে প্রবেশ করেছিল, কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে যে এ জমিদার পুরুষক্রমে যা করেছেন, যেটা দু ছত্রে বলা যায়,
পাকা রাস্তা বানিয়ে বসে দুঃখীর বুক জুড়ি
ভগবানের ব্যথার পরে হাঁকায় সে চার-ঘুড়ি।
(আবার রবীন্দ্রনাথ! এই মুহম্মদি মামদোর ওপর তিনি আর কত বত্সর ভর করে থাকবেন!) সেই পিচেশি রক্তশোষণ সে চিরতরে বন্ধ করবে–আপ্রাণ সগ্রাম দিয়ে, প্রয়োজন হলে পরমারাধ্য স্বামীকে পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ দিয়ে, ডিফাই করে।
এবং দিয়েও ছিল সে মোক্ষম লড়াই তার খাণ্ডারনি শাশুড়ির বিরুদ্ধে তিনিই ছিলেন এই প্রজা-শোষণ-উচাটনের চক্রবর্তিনী।
সংক্ষেপে সারি। তার বহু বৎসর পরে কী পরিস্থিতি উদ্ভাসিত হল? সেই পূর্বেরটাই। যথা পূর্বং তথা পরং! যদ্বৎ তদ্বৎ পূর্ববৎ। ইতোমধ্যে শাশুড়ি মারা গিয়েছেন এবং সেই বিদ্রোহী তনুদেহধারিণী বধূটি দশাসই গাড়গুম কলেবর ধারণ করে হয়ে গেছেন সে-অঞ্চলের ডাকসাইটে রক্তশোষিণী!
ট্র্যাডিশন! ট্র্যাডিশন!! সেই দ’ থেকে বাঁচে কটা ডিঙি?
কিংবা রবীন্দ্রনাথের সেই কথিকাটি স্মরণে আনুন :
বুড়ো কর্তার মরণকালে দেশসুদ্ধ সবাই বলে উঠল, তুমি গেলে আমাদের কী দশা হবে।… দেবতা দয়া করে বললেন… লোকটা ভূত হয়েই এদের ঘাড়ে চেপে থাক না। মানুষের মৃত্যু আছে, ভূতের তো মৃত্যু নেই।
সেই ভূতই হল ট্র্যাডিশন!
তার পর মনে আছে সেই ভূত-ট্র্যাডিশনের পায়ের কাছে দেশসুদ্ধ সবাইকে কী খাজনা দিতে হল?
শ্মশান থেকে মশান থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় হা হা করে উত্তর আসে (খাজনা দেবে] আব্রু দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে, ইমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে।
সৈয়দ সাহেব, আমি ট্র্যাডিশন ভূতের খপরে সে-খাজনা দিতে রাজি ছিলুম না। তার কারণ এ নয় যে আমি কৃপণ। কিন্তু এ মূল্য দিলে যে আমার সর্বসত্তা লোপ পাবে, আমার ধর্ম আমার ইমান যাবে।
সুভদ্রা আশাপূর্ণার সেই বন্ধুর মতো দিনে দিনে আপন সত্তা হারিয়ে হারিয়ে আমি আমার শ্বশুরবাড়ির অচলায়তনে বিলোপ হতে চাইনি। সেইটেই হতো আমার মহতী বিনষ্টি।…
কিন্তু তবু জানেন, সৈয়দ সাহেব, হাসিকান্না হীরাপান্না রান্নাবান্না নিয়ে আমার দৈনন্দিন জীবন কেটে যাচ্ছিল। আমাদের কচিকাঁচা বয়সে একটা মামুলি রসিকতার কথোপকথন ছিল, কী লো, কীরকম আছিস? কেটে যাচ্ছে, কিন্তু রক্ত পড়ছে না। আমার বেলা কিন্তু দিন কাটার সঙ্গে সঙ্গে হৃৎপিণ্ড কেটে কেটে রক্ত ঝরে ঝরে ফুসফুসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে সেগুলোকে বন্ধ করে দিয়ে আমার স্বাসপ্রশ্বাস নিরুদ্ধনিশ্বাস করে তুলছিল। সর্বশেষে একদিন আমাকে ডুবে মরতে হত, আমার আপন দিল-ঝরা খুনে। আমি কর্তার কাছে শুনেছি, যুদ্ধের সময় বুলেটের সামান্যতম এক অংশ যদি হৃৎপিণ্ডে ঢুকে সেটাকে জখম করতে পারে তবে তারই রক্তক্ষরণের ফলে সমস্ত ফুসফুস ফ্লাডেড় হয়ে যায়, এবং বেচারা আপন রক্তে ড্রাউনড় হয়ে মারা যায়।
অবশ্য আমার বেলা বুলেটের টুকরো নয়। ওই ভুতুড়ে বাড়ির ট্র্যাডিশনের একখানা আস্ত চাই।…
আপনি অবশ্যই শুধোবেন, অকস্মাৎ তোমার এ পরিবর্তন এল কী করে?
পরিবর্তন নয়। জাগরণ। নব জাগরণ।
***
রূপনারাণের কূলে
জেগে উঠিলাম।
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ…
আমার নব জাগরণের পর আমি এ কবিতাটি নিয়ে অনেক ভেবেছি। স্পষ্টত এখানে রূপনারাণ রূপকার্থে। অবশ্য এর পিছনে কিছুটা বাস্তবতাও থাকতে পারে। শুধু পদ্মায় নয়, কবি গঙ্গাতেও নৌকোয় করে সফরে বেরুতেন। হয়তো বজবজ অঞ্চলে কোথাও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন; হঠাৎ ঘুম ভাঙল ডায়মন্ড হারবারের একটু আগে যেখানে রূপনারায়ণ নদী গঙ্গার সঙ্গে এসে মিশেছে। জেগে উঠলেন রূপনারাণের কূলে, কোলেও হতে পারত। স্বপ্ন দেখছিলেন এতক্ষণ। অর্থাৎ তার আশি বৎসরের জীবন স্বপ্নে স্বপ্নে, স্বপ্নের অবাস্তবতায় কাটাবার পর হঠাৎ রূপনারাণের কূলে পরিপূর্ণ বাস্তবের অর্থাৎ রূপের সম্মুখীন হলেন। এক আলঙ্কারিক রূপের ডেফিনিশন দিতে গিয়ে বলেছেন, ভূষণ না থাকলেও যাকে ভূষিত বলে মনে হয় তাই রূপ। অর্থাৎ পিওর, নেকেড রিয়ালিটি। তার কোনও ভূষণ নেই।
আর নারায়ণ অর্থ তো জানি; নরনারী যার কাছে আশ্রয় নেয়।
আমি অন্তত এই অর্থেই কবিতাটি নিয়েছি।
তাই আমি জপ করি সেই আল্লার (নারায়ণ) আশ্রয় নিয়ে, তার রূপস্বরূপকে স্মরণ করে, যার নাম লতিফ (সুন্দর)। এবং তিনি শিব এবং সত্যও বটেন।