রাখাল ছেলে বললে, সে আর দেখিনি? কিন্তু তুমি, ভাই, করেছ কী? শেষবিচার কিয়ামতের দিন, আল্লার হুকুমে ফিরিশতা ইসরাফিল যখন শিঙে বাজাবেন তখন কত লক্ষ মণ পাথর খুঁড়ে খুঁড়ে ভেঙে ভেঙে উঠতে হবে বেহেশত বাগে। তাঁর জন্য এ মেহেন্নতি তৈরি করলে কেন?… আর আমার বাবা তার গোরের উপরকার আধ হাত মাটি এক ধাক্কায় ভেঙে ফেলে হুশ হুশ করে চলে যাবে আল্লার পায়ের কাছে।
***
প্রিয় সৈয়দ সাহেব, আমাকে দিয়েছে জ্যান্ত গোর বিরাট ইট-সুরকির এই বাড়িতে। বধূ হয়ে যে-সন্ধ্যায় এ বাড়িতে প্রথম প্রবেশ করি তখনই আমার শরীরটা কেমন যেন একটা শীতলতার পরশে সিরসির করেছিল, যদিও আমার পরনে তখন অতি পুরু আড়ি-বেল বেনারসি শাড়ি, কিংখাপের জামা আর সর্বাঙ্গ জড়িয়ে আপনার ডাক্তারের ঠাকুমার কাশ্মিরি শাল– যার সাচ্চা জরির ওজনই হবে আধসের।
আপনি এ বাড়ির অতি অল্প অংশই চেনেন। এ বাড়ির পুরো পরিক্রমা দিতে হলে ঘন্টাটাক লাগার কথা। আমাকে কয়েকদিন পরপরই এ পরিক্রমা লাগাতে হয়। প্রথম প্রথম খুব একটা মন্দ লাগত না– প্রাচীনদিনের কতশত সম্পদ, টুকিটাকি, নবীন দিনের সঞ্চয়ও কিছু কম যায় না এস্তেক কার যেন প্রেজেন্ট দেওয়া একটা টেলিভিশন সেট– যদিও কবে যে এটা কাজে লাগবে, সেটা ভবিষ্যতের গর্ভে! যেন যাদুঘরে এটা-ওটা দেখছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি।
কিন্তু চিন্তা করুন, যদি আপনাকে যাদুঘরে আহারন্দ্রিা দাম্পত্য-জীবন যাপন করতে হয়, তবে কীরকম হাল হয়!
তবু বলি, এ-ও কিছু নয়। সামান্য ইট-পাথর, প্রাচীনদিনের সঞ্চয়– এরা প্রাণহীন। এরা আমার মতো সজীব প্রাণচঞ্চল জীবকে আর কতখানি সম্মোহিত করবে?
কিন্তু এরা যে সবাই সর্বক্ষণ চিৎকার করে করে আমাকে শোনাচ্ছে,
ট্র্যাডিশন! ট্র্যাডিশন!! ঐতিহ্য! ঐতিহ্য!!
সবাই বলছে, সাত পুরুষ ধরে এই খানদানি পরিবারে যা চলে আসছে, সেইটেই তোমাকে মেনে চলতে হবে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে, এবং মরার সময়ও তার ভবিষ্যতের জন্য পরিপাটি ব্যবস্থা করে যেতে হবে।
আর যারা জ্যান্ত? নায়েব, তাঁর পরিবারবর্গ, এ বাড়ির দারওয়ান ড্রাইভার বাবুর্চি চাকর হালালখোর, পাশের মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিন সক্কলের চেহারাতেই ওই একটি শব্দ নিঃশব্দে ফুটে উঠছে : ট্র্যাডিশন। বিগলিতাৰ্থ : বেগমসাহেবা যদি খানদানি প্রাচীন পন্থা মেনে চলেন তবে আমরা তার গোলামের গোলাম, আমরা নামাজের পর পাঁচ বেকৎ আল্লার পদপ্রান্তে লুটিয়ে বলব, ইয়া খুদা, এই শহর-ইয়ার বানু জিললুল্লা, এই দুনিয়ায় আল্লার ছায়া। তাঁরই সুশীতল ছায়াতে আমাদের জীবন, আমাদের সংসার, আমাদের মৃত্যু, আমাদের মোক্ষ। তুমি তাকে শতায়ু কর, সহস্ৰায়ু কর! আমেন!
আমি সিনিক নই। তাদের এ প্রার্থনায়, তাদের ঐতিহ্যরক্ষার্থ-কামনায় প্রচুর আন্তরিকতা আছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আছে সেই আদিম ইনসটিনকট, জীবনসংগ্রামে কোনওগতিকে টিকে থাকবার, কোনওগতিকে বেঁচে থাকবার প্রচেষ্টা।… আজ যদি কালীঘাটের মন্দির নিশ্চিহ্ন করে পুরুৎ-পুজোরিদের আদেশ দেন চরে খাও গে! তবে তারা যাবে কোথায়? বর্তমান যুগোপযোগী জীবনসংগ্রামে যুদ্ধ করার মতো কোনও ট্রেনিং তো এদের দেওয়া হয়নি। এদের অবস্থা হবে, খাঁচার পাখিকে হঠাৎ ছেড়ে দিলে যা হয়। খাঁচার লৌহদুর্গে দীর্ঘকাল বাস করে সে আত্মরক্ষার কৌশল ভুলে গিয়েছে, দু বেলা গেরস্তের তৈরি ছোলা-ফড়িং খেয়ে খেয়ে ভুলে গিয়েছে আপন খাদ্য সংগ্রহ করার ছলা-কলা।
আবার আমার লোক-লস্করের কথায় ফিরে আসি। এদের সবাইকে যদি আমি কাল ডিসমিস করে দিই– সে এক্তেয়ার ডাক্তার আমাকে দিয়েছেন– তবে কী হবে? অধিকাংশই না খেয়ে মরবে। তারা শুধু জানে ট্র্যাডিশন। তাদের জন্ম হয়েছে এ শতাব্দীতে, কিন্তু মৃত্যু হয়ে গিয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই।
আমি একাধিকবার চেষ্টা দিয়েছিলুম এ বাড়িতে ফ্রেশ ব্লাড় আমদানি করতে। চালাক-চতুর দু একটি ছোকরাকে বয় হিসেবে নিয়ে এসেছি। জানেন কী হল? পক্ষাধিক কাল যেতে না যেতেই তারা ভিড়ে গেল প্রাচীনপন্থি দারওয়ান-বাবুর্চির সঙ্গে। বুঝে গেল, রুটির ওই-পিঠেই মাখন মাখানো রয়েছে। সিনেমা যাওয়া পর্যন্ত তারা বন্ধ করে দিল। অক্লেশে হৃদয়ঙ্গম করলুম, দেড়শো কিংবা তারও বেশি বছরের ট্র্যাডিশনের মায়াজাল ছিন্ন করার মতো মোহমুর আমি রাতারাতি– রাতারাতি দূরে থাক, বাকি জীবনভর চেষ্টা করলেও নির্মাণ করতে পারব না।
অবশ্য আমার দেবতুল্য স্বামী আমাকে বাসরঘরেই সর্বস্বাধীনতা দিয়েছিলেন, সর্ব বাবদে– সে-কথা আমি আপনাকে পূর্বেই বলেছি। কিন্তু স্বাধীনতা দিলেই তো সব মুশকিল আসান হয়ে যায় না। স্বাধীনতা পেয়ে খাঁচার পাখিটার কী হয়েছিল? অনাহারে যখন ভিরমি গিয়ে চৈত্রের ফাটাচেরা মাঠে পড়ে আছে, তখন শিকরে পাখি তাকে ছো মেরে তুলে নিয়ে গাছের ডালে বসে কুরে কুরে তার জিগর-কলিজা খেল।
***
সে-কথা জানে বলেই এ বাড়ির লোক আমাকে প্রথম দিনই খাঁচাতে পুরতে চেয়েছিল। ওরা সবাই ট্র্যাডিশনের খাঁচাতে। খাঁচার ভিতরকার নিরাপত্তা, অন্নজল বাইরে কোথায় পাবে? আমাদের এক সমাজতত্ত্ববিদ নাকি বলেছেন, ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা না পেলেই নাকি আমাদের পক্ষে ভালো হত। ওঁর বক্তব্য, ইংরেজ আমলে নাকি আমাদের ঘৃতলবণতৈলতলবস্ত্র-ইন্ধনের দুশ্চিন্তা ছিল অনেক কম।