আপনাদের ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে আপনার সম্মুখে শেষবারের মতো আমার শেষ গুরুদক্ষিণা নিবেদন করে গেলুম।
***
কিন্তু মেয়েদের এই শূন্যতা, দীনতা, ফ্রাসট্রেশনের জন্য দায়ী কে?
নারী হয়েও বলব, তার জন্য সর্বাগ্রে দায়ী রমণীকুল। প্রধানত।
আপনারই গুরু স্বৰ্গত ক্ষিতিমোহন সেনের দেশে প্রকাশিত রচনাতে একটি সুভাষিত পড়েছিলুম–
কুঠারমালিনং দৃষ্টা
সর্বে কম্পান্বিতা দ্রুমাঃ।
বৃদ্ধ দ্রমো বক্তি, মা ভৈঃ
ন সন্তি জ্ঞাতয়ো মম ॥
কুঠারমালাধারীকে দেখে সমস্ত গাছ যখন কম্পান্বিত তখন বৃদ্ধ একটি গাছ বললে, এখনই কিসের ভয়? এখনও আমাদের (জ্ঞাতি) কোনও গাছ বা বৃক্ষাংশ ওর পিছনে এসে যোগ দেয়নি।
শহর-ইয়ার লিখছে, বড় হক্ কথা। কামারের তৈরি কুড়োলের সুন্দুমাত্র লোহার অংশটুকুন দিয়ে কাঠুরে আর কী করতে পারে, যতক্ষণ না কাঠের টুকরা দিয়ে ওই লোহায় ঢুকিয়ে হ্যাঁন্ডিল বানায়। পুরুষজাত ওই লোহা; সাহায্য পেল মেয়েদের সহযোগিতায় কাঠের হ্যাঁন্ডিল। তাই দিয়ে যে-মেয়েরই একটু বাড় হয় তাকে কাটে, আর যেগুলো নিতান্ত নিরীহ চারাগাছ বা যেসব বছর-বিয়ানীরা গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা বিইয়ে বিইয়ে জীবন্ত তাদের রেহাই দেয়।
এইসব অপকর্মে যুগ যুগ ধরে সাহায্য করেছে মেয়েরাই। শুনেছি, সতীদাহের পুণ্যসঞ্চয় করার জন্য বিধবাকে প্ররোচিত করেছে সমাজাগ্রগণ্যা নারীরাই।
এতদিন বলিনি, এইবারে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নেবার বেলা বলি, এই কলকাতার মুসলমান মেয়েরা– দু চারটি হিন্দুও আছেন আপনার সঙ্গে আমার অবাধ মেলামেশা দেখে টিডিট্টকার দেয়নি? বেহায়া বেআব্রু বেপর্দা বেশরম, তওবা তওবা বলেনি? তবে কি না, আপনি বিলক্ষণ অবগত আছেন, চাঁদের অমিয়া সনে চন্দন বাটিয়া হয়তো আমার দেহ এমনকি হৃদয়ও মাজা হয়েছে, কিন্তু আমার মস্তিষ্ক, তজ্জনিত বুদ্ধি এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে অবহেলা করার মতো আমার গণ্ডারচর্মবিনিন্দিত দার্চ নির্মিত হয়েছে, সুইডেনের প্যোর স্টেনলেস স্টিল ও সাউথ আফ্রিকার আন্-কাট ডায়মন্ড মিশিয়ে। আর আছেন, ভূতনাথের ঠাকুমা। যাকে বলতে পারেন আমার টাওয়ার অব্ পাওয়ার।
তদুপরি আমার অভিজ্ঞতা বলে, এইসব আজ-আছে-কাল-নেই জিভের লিকলিকিনি অনেকখানি বিঘ্নসন্তোষমনা পরশ্রীকাতরতাবশত। ইলিয়েট রোডের সায়েব-মেমরা বড়দিনে যখন নানাবিধ ফুর্তির সঙ্গে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ধেই ধেই করে নৃত্য করে তখন আমরা হিন্দু-মুসলমানরা– প্রাণভরে ছ্যা ছ্যা করি বটে, কিন্তু তখন কসম খেতে হলে ধোওয়া তুলসীপাতাটির পার্ট প্লে করা বন্ধ করে স্বীকার করতে হবে, মনের গোপন কোণে হিংসেয় মরি, হায়! আমাদের রদ্দি বুড়া সমাজ এ আনন্দ থেকে আমাদের বঞ্চিত করল কেন? নয় কি? সত্য বলুন। কিন্তু আপনার কথা আলাদা। আপনি বিদেশে বিস্তর নেচেছেন, আর এখন, আমাদের মতো নিরীহদের মৃদুমন্দ নাচাচ্ছেন। আহা! গোস্সা করলেন না তো? শুনেছি, সৈয়দরা বড্ড রাগী হন। তবে সঙ্গে সঙ্গে একটা সান্ত্বনার বাণীও পেয়েছি; ওয়াদের রাগ নাকি খড়ের আগুনের মতো ধপ করে জ্বলে আর ঝাপ্ করে যায় নিভে– সঙ্গে সঙ্গে।
অবশ্য একটা জিনিস আমাকে গোড়ার দিকে কিছুটা বেদনা দিয়েছিল– এইসব নগণ্য ক্ষুদে ক্ষুদে, কিন্তু বিষেভর্তি চেরা-জিভ যখন আমার স্বামী, আপনার বন্ধু ডাক্তারের বিরুদ্ধে হি হি করে বিষ বমন করত। সেখানে আমি যে নাচার। আমি কীরকম জানেন? আপনার ডাক্তার যখন কোনও রুগীকে ইনজেকশন দেয় তখন আমি সেদিকে তাকাতে পারিনে। আমার বলতে ইচ্ছে করে, না হয় দাও না, বাপু, ইনজেকশনটা আমাকেই।
অবশ্য আল্লার মেহেরবানি। ডাক্তারের কাছে এসব হামলা পৌঁছয় না। তার রিসার্চ ক্লফরম দিয়ে তিনি তার পঞ্চেন্দ্রিয় অবশ অসাড় করে রেখেছেন।
আপনাকে বলেছি কি সেই গল্পটা? এটি আমি শুনেছি বাচ্চা বয়সে আমাদের বাড়ির এক নিরক্ষরা দাসীর কাছ থেকে। তাই এটা হয়তো লোকমুখে প্রচলিত আঞ্চলিক কাহিনী মাত্র– কেতাব-পত্রে স্থান পায়নি বলে হয়তো আপনার অজানা।
এক বাদশা প্রায়ই রাজধানী থেকে দূরে বনের প্রান্তে একটি নির্জন উদ্যান-ভবনে চলে যেতেন শান্তির জন্য। সেখানে বালক যুবরাজের ক্রীড়াসঙ্গী নর্মখা-রূপে জুটে যায় এক রাখাল ছেলে। তাদের সখ্যে রাজপুত্র-কৃষকপুত্রের ব্যবধান ছিল না।
বাদশা মারা গেলে পর যুবরাজ বাদশা হলেন। দীর্ঘ কুড়ি বৎসর ধরে যুবরাজ আর সুযোগ পাননি সেই উদ্যান-ভবনে আসার। যখন এলেন তখন সন্ধান নিলেন তার রাখাল বন্ধুর স্বয়ং গেলেন তার পর্ণকুটিরে। রাখাল ছেলে পূর্বেরই মতো মোড়ামুড়ি দিল। যুবরাজ শুধোলেন, তোমার বাপকে দেখছি না যে?
তিনি তো কবে গত হয়েছেন! আল্লা তার আত্মার মঙ্গল করুন।
গোর দিলে কোথায়?
ওই তো হোথায়, খেজুরগাছটার তলায়। বাবা ওই গাছের রস আর তাড়ি খেতে ভালোবাসত বলে আমাকে আদেশ দিয়ে গিয়েছিল তাকে যেন ওরই পায়ের কাছে গোর দিই। (নাগরিক বিদগ্ধ ওমর খৈয়ামও দ্রাক্ষাকুঞ্জে সমাধি দিতে বলেছিলেন, না?)
রাখাল ছেলে জানত, আগের বাদশা গত হয়েছেন। তাই শুধাল, আর হুজুর বাদশার গোর কোথায় দেওয়া হল?
ঈষৎ গর্বভরে নবীন রাজা বললেন, জানো তো রাজা-বাদশারা বড় নিমকহারাম হয়, বাপের গোরের উপর কোনও এমারৎ বানায় না।…আমি, ভাই, সেরকম নই। বাবার গোরের উপর বিরাট উঁচু সৌধ নির্মাণ করেছি, দেশ-বিদেশ থেকে সর্বোত্তম মার্বেলপাথর যোগাড় করে।…এই বনের বাইরে গেলেই তার চুড়োটা এখান থেকেও স্পষ্ট দেখা যায়।