***
আত্মচিন্তা স্বদেহ-ডংশন স্থগিত রেখে আবার শহর-ইয়ারের চিঠিতে ফিরে গেলুম। এবং সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করছি, নির্লজ্জের মতো স্বীকার করছি, অকস্মাৎ পুরুষবিদ্বেষে রূপান্তরিত এ রমণীর জাতক্রোধে পরিপূর্ণ এই পত্রখানা আমার খুব একটা মন্দ লাগছিল না।
এর পর ইয়ার লিখছে–
আদিখেত্তা, না, আদিখ্যেতা? কিন্তু আপনি এই মেয়েলী শব্দটি বুঝবেন। আপনি ভাবছেন, আমি আদিখেত্তা, বা আপনাদের ভাষায় আধিক্যতা করছি। কিন্তু আপনি তো অন্তত এইটুকু জানেন যদিও, অপরাধ নেবেন না, স্ত্রী-চরিত্রে আপনার জ্ঞান এবং অনুভূতি ঠিক ততটুকু, যতটুকু একটা অন্ধ এস্কিমোর আছে, হুগলি নদীর অগভীর বিপদসঙ্কুল ধারায় পাইলট জাহাজ চালাবার আপনি নিশ্চয়ই জানেন, এ হাহাকার দৈন্যের মরুভূমিতে আমি একা নই, আমার মতো বিস্তর রমণী রয়েছে যাদের জীবন শূন্য। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েই। কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশেষ করে হিন্দু রমণী– সেটা জীবনভর এমনই আশ্চর্য সঙ্গোপনে রাখে যে তাদের নিকটতম আত্মজনও তার আভাসমাত্র পায় না। গুরুর গানে আছে তার বেদনার
ভরা সে পাত্র তারে বুকে করে
বেড়ানু বহিয়া সারা রাতি ধরে।
আর এই রমণীদের বেলা তাদের বেদনার
ভরা সে পাত্র তারে বুকে করে
বেড়ানু বহিয়া সারা আয়ু ধরে।
ওই যে আপনার ভক্ত খানের ঠাকুরমা। তিনি যে তাঁর সমস্ত জীবন শূন্যে শূন্যে কাটিয়েছেন তার আভাস কি তার জাদু ভূতনাথ (হোয়াট এ নেম! আমার বিশ্বাস ওর বাপ-মা তার নাম রেখেছিলেন অনিন্দ্যসুন্দর খান এবং বড় হয়ে, অ্যাজ এ প্রটেস্ট, সে অন্য একসট্ৰিমে গিয়ে, এফিডেভিট দিয়ে ভূতনাথ নাম নেয়) পর্যন্ত পেয়েছে?
ওই ঠাকুরমার শূন্যতা এবং আমার শূন্যতা যেন হংসমিথুনের মতো আমাদের একে অন্যকে কাছে টেনে নিয়ে আসে। ওদিকে উনি নিষ্ঠাবতী ব্রাহ্মণী এবং আমিও গরবিনী মুসলমানী। শুনেছি, প্রলয়ঙ্করী বন্যার সময় একই গাছের গুঁড়ির উপর ঠাসাঠাসি করে সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর, নকুল, গোসাপ নিরাপদ তীরের আশায় ভেসে ভেসে যায়। কেউ তখন কারও শত্রুতা করে না, এমনকি আপন অসহায় ভক্ষ্য প্রাণীকেও তখন আক্রমণ করে না। আর আমাতে-ঠাকুমাতে তো পান্না-সোনায় মিটি মানানসই। আমরা দু জনা বসে আছি একই নৌকায়। একমাত্র রাজনৈতিক সুবিধাবাদীরা বলে, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কটা অহি-নকুলের আজকের দিনের ভাষায় বুর্জুয়া প্রলেতারিয়ার। আর আমাদের উভয়ের সামনে,
ঢেউ ওঠে পড়ে কাদার, সম্মুখে ঘন আঁধার
পার আছে কোন দেশে …
হাল-ভাঙা পাল-ঘেঁড়া ব্যথা।
চলেছে নিরুদ্দেশে।
পথের শেষ কোথায় শেষ কোথায়
কী আছে শেষে!
ওই তো আমার দোষ। কোনও-কিছু বলতে গেলেই আমার রসনায় এসে আসন নেন রবিঠাকুর, কালিদাসের রসনায় যে রকম বীণাপানি আসন জমিয়ে মধুচক্র গড়তেন। আর লোকে ভাবে হয়তো ঠিকই ভাবে আমার নিজস্ব কোনও ভাব-ভাষা নেই, আমি চিত্রিতা গর্দভী–রবিকাব্যের গামলার নীল রঙে আমার ধবলকুষ্ঠের মতো সাদা চামড়াটি ছুপিয়ে নিয়ে নবজলধরশ্যাম কলির মেকি কেষ্ট হয়ে গিয়েছি!
কিন্তু আপনি জানেন, আপনাকে অসংখ্য বার বলেছি, আমি রাজা পিগমালিয়োন– এস্থলে রবীন্দ্রনাথ নির্মিত মর্মরমূর্তি। বরঞ্চ তারও বাড়া। পিগমালিয়োন তার গড়া প্রস্তরমূর্তিতে প্রাণসঞ্চার করতে অক্ষম ছিলেন বলে দেবী আফ্রোদিতেকে প্রার্থনা করেন, তাঁর সেই মূর্তিটিকে জীবন্ত করে দিতে। দেবীরা পূর্বের কথা স্মরণ করে দিয়ে আবার বলছি, পুরুষের তুলনায় তারা চিরন্তনী করুণাময়ী। ধন্য মা মেরি, তুমি, মা, পূর্ণ করুণাময়ী সর্বদেবীর সর্বশেষ সর্বাঙ্গসুন্দরী মা-জননী– দেবী আফ্রোদিতে রাজার বর পূর্ণ করে দিলেন। এ স্থলে দেবীর এমন কী কেরামতি, কী কেরানি! পক্ষান্তরে দেখুন, আমার এই মূর্তদেহ নির্মাণের জন্য, প্রশংসা হোক, নিন্দা হোক, সেটা পাবেন আমার জনক-জননী। কিন্তু সে-দেহটাকে চিন্ময় করল কে? গানে গানে, রসে রসে, রামধনুর সপ্তবর্ণের সঙ্গে মিশিয়ে তার ভিতর দিয়ে উড়ে-যাওয়া নন্দনকানন-পারিজাত রঙে রঞ্জিত প্রজাপতির কোমল-পেলব ডানা দুটির বিচিত্রবর্ণে, নবীন উষার পুস্পসুবাসে, প্রেমে প্রেমে, বিরহে বিরহে, বেদনা বেদনায় কে নিরমিল আমার হৃদয়, আমার স্পর্শকাতরতা, কোণের প্রদীপ যেরকম জ্যোতিঃসমুদ্রে মিলিয়ে যায় হুবহু সেইরকম সৌন্দর্যসাগরে ক্ষণে ক্ষণে দিনে দিনে আমার নিজের সত্তাকে বিলীন করে দেবার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত আকুলতা– এটি নির্মাণ করল কে? মহাপ্রভুর বর্ণ দেখে কে যেন রচেছিলেন– শব্দে শব্দে মনে নেই–
চাঁদের অমিয়া সনে চন্দন বাটিয়া গো,
কে মাজিল গোরার দেহখানি!
ভারি সুন্দর! আকাশের চাঁদ আর পৃথিবীর চন্দন অর্থাৎ স্বর্গের দেবতা চন্দ্র আর এই মাটির পৃথিবীর চন্দন দিয়ে, ক্রন্দসী দ্বারা স্বৰ্গমর্তের সমন্বয়ে মাজা হল গৌরাঙ্গের দেহখানি! কিন্তু মহাপ্রভুর ভাষাতেই বলি এহ বাহ্য। দেহ তো বাইরের বস্তু।
বার্নার্ড শ রাজা পিগমালিয়োনকে অবশ্যই ছাড়িয়ে গিয়েছেন। তিনি তাঁর মূর্তি এলাইজাকে দিলেন সুমিষ্ট ভাষা এবং সুভদ্র বিষয় নিয়ে সর্বোকৃষ্ট সমাজে আলোচনা করার অনবদ্য দক্ষতা।
শ’কে ছাড়িয়ে বহু বহু সম্মুখে এগিয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। আমার চিত্ময় স্বময় জগৎ নির্মাণ করে তিনি আমাকে যে বৈভব দিয়েছেন, শর সৃষ্টি তার শতাংশের একাংশও পায়নি।