আমার লেকচার আর শেষ হল না। ইতোমধ্যে শুনি শহর-ইয়ার খিলখিল করে হাসতে আরম্ভ করেছেন। হাসি আর কিছুতেই থামে না। ইয়োরোপীয় সমাজতত্ত্ব সম্বন্ধে আমার এই সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে এতখানি হাসবার কী থাকতে পারে, আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না।
হাসি পুরো থামার পূর্বেই শহর-ইয়ার বলতে লাগলেন, এবং বলার মাঝে মাঝেও চাপা হাসি কলকলিয়ে উঠল– আপনি কি বেবাক ভুলে গেলেন, ট্রেনে আমি নিজে, স্বেচ্ছায়, গায়ে পড়ে, ইংরেজিতে যাকে বলে উইদাউট এনি প্রোভোকেশন, আপনার সঙ্গে আলাপ করেছিলুম?
আমি বললুম, কী আশ্চর্য! আমি এমনি একটা উদাহরণ দিচ্ছিলুম। আমি কি আর আপনি– আমি ডাক্তারের কথা ভাবছিলুম?
শহর-ইয়ার তবু হাসতে হাসতে বললেন, বুঝেছি বুঝেছি, খুব ভালো করেই বুঝেছি। ইয়োরোপের উদাহরণ যে এদেশে খাটে না সে আমি ভালো করেই জানি। ইয়োরোপের কেন, বাঙালি হিন্দুর উদাহরণও আমাদের বেলা সর্বক্ষেত্রে খাটে না, সে-ও তো জানা কথা। জানেন, এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি।
যে সাহিত্য মানুষ পড়ে সেটা যে তার জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে এ তো জানা কথা। বাঙলা সাহিত্য গড়ে তুলেছে হিন্দুরা। বৈষ্ণব পদাবলি থেকে রবীন্দ্রনাথ। সৈয়দ আলাওল বা নজরুল ইসলাম তো এমন কোনও জোরালো ভিন্ন আদর্শ দিয়ে যাননি যার উল্লেখ করা যেতে পারে। এই হিন্দুর গড়া বাঙলা সাহিত্যে বিবাহিতা নারীর আদর্শ কী, সে তো সবাই জানে। সে সহধর্মিণী, অর্ধাঙ্গিনী এবং সর্বোপরি সে পতিব্রতা। ওদিকে দেখুন আপনার স্ত্রী আপনার সহধর্মিণী না-ও হতে পারেন, তিনি যদি খ্রিস্টান হন। এবং এই পন্ত্রিতার আদর্শটা আমাদের, মুসলমানদের ভিতর তো ঠিক সেরকম নয়। কোনও সন্দেহ নেই, স্ত্রী সেবা করবে, ভালোবাসবে তার স্বামীকে, তার সুখ-দুঃখের ভাগী হবে, তার আদেশ মেনে চলবে– কিন্তু, এখানে একটা বিরাট কিন্তু আসে– স্ত্রী তার সর্বসত্তা সর্বব্যক্তিত্ব সর্বঅস্তিত্ব স্বামীতে লীন করে দিয়ে পব্ৰিতা হবে এ কনসেপশন তো আমাদের ভিতর নেই। খুব একটা বাইরের মামুলি উদাহরণ নিন। আমার আব্বাজানের নাম মুহম্মদ আল্লাবখৃশ খান– তাঁর পূর্বপুরুষ পাঠান হন আর না-ই হন, তাঁরা সাতপুরুষ খান উপাধি ব্যবহার করেছেন। আমার আম্মা আবার চৌধুরীবাড়ির মেয়ে– তাই তিনি শেষদিন পর্যন্ত নামসই করেছেন মিহরুন্নিসা চৌধুরী। তিনি মাত্র কয়েক বছর হল ওপারে গেছেন। শেষের দিকে সবাই যখন হালফ্যাশান মাফিক তাঁকে বেগম খান, মিসেস খান বলে সম্বোধন করছে তিনি তখনও সই করছেন, মিহরুন্নিসা চৌধুরী।
আমি শুধালম, সমস্যাটা ঠিক কোনখানে আমি বুঝতে পারছিনে। অর্থাৎ বাঙালি মুসলমান মেয়ের বিশেষ সমস্যাটা কোনখানে?
শহর-ইয়ার বড় মধুরে হাসল। বললে, আমার মগজটা বড্ডই ঘোলাটে আর হৃদয় সেটা যেন ফেটে ফেটে বেরুতে চায়, তাই না আপনাদের বাঙালি মেয়ে বলেছে,
ইচ্ছা করে কলিজাডারে
গামছা দিয়া বান্ধি
শুনুন। হিন্দু মেয়েরা অন্দর থেকে বেরিয়েছেন কবে? বছর তিরিশের বেশি হবে না। অথচ স্বরাজ লাভের ফলে এবং অর্থনৈতিক অবনতিবশত কিংবা আকাশে-বাতাসে এক অভিনব সর্বব্যাপী স্বাধীনতার আবহাওয়া সৃষ্ট হওয়ার দরুন এই দশ-পনরো বৎসরেই মুসলমান মেয়েরা দ্রুত হিন্দুদের কাছাকাছি এসে যাচ্ছে। গত ত্রিশ বৎসর ধরে হিন্দু মেয়েরা এই যে তাদের আংশিক স্বাধীনতা ক্রমে ক্রমে বাড়িয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে তারা জানা-অজানায় চেষ্টা করছে সে স্বাধীনতা ঠিক কীভাবে কাজে লাগাবে, তার কোস্ কী, তার নম্ কী। একটা সামান্য দৃষ্টান্ত নিন। কন্টিনেন্টে কোনও মেয়ে যদি বিয়ের উদ্দেশ্যে কিংবা অন্য যে কোনও উদ্দেশ্য নিয়েই হোক তার পরিচিতের সংখ্যা বাড়াতে চায় তবে সে তার বান্ধবী নিদেন ল্যান্ডলেডির সঙ্গে নাচের হলে যায়। পুরুষরা এসে বাও করে নাচবার জন্য নিমন্ত্রণ জানায় তার জন্য কোনও ফর্মাল ইনট্রোডাকশন দরকার নেই এবং এই করে করে মেয়েরা যত খুশি তাদের পরিচিতের সংখ্যা বাড়াতে পারে। এদেশে এখনও সমস্তটা চান। বান্ধবীর মাধ্যমে, অফিসের সহকর্মিণীদের মাধ্যমে যে আলাপ-পরিচয় হয় সেটাকে উটকো মেথড– অর্থাৎ চান্স্ বলা যেতে পারে।
আমার বক্তব্য, হিন্দু মেয়েরা যে উদ্দেশ্যে চলেছে সেটা মুসলমানদের ঠিক সুট করবে না।
একটা কথা তো ঠিক, স্ত্রী-স্বাধীনতা অর নো স্ত্রী-স্বাধীনতা সাড়ে পনরো আনা মেয়ে বিয়ে করে মা হতে চায়। পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে, আপন স্বাধীন স্বেচ্ছায় হিন্দু মেয়ে বর বাছাই করে নিয়ে হবে– কী হবে?– পন্ত্রিতা।
মুসলমান মেয়েও ঠিক ওই একই পন্থায় আপন স্বামী বেছে নেবে কিন্তু সে হিন্দু মেয়ের মতো পতিব্রতা হওয়ার আদর্শ বরণ করে নিতে পারবে না। দোহাই আল্লার, তার অর্থ এই নয় যে সে অসতী হবে– তওবা, তওবা!–তার অর্থ, আবার বলছি, সে তার সর্বসত্তা স্বামীতে বিলীন করে দিতে পারবে না।
আপনি ভাববেন না, আমি কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেকথা বলছি– আমি শুধু। পার্থক্যটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি।
আমি বললুম, পতিব্রতা-ফতিব্রতার আদর্শ আজকাল হিন্দু রমণীরা কি আর খুব বেশি বিশ্বাস করে? আর আজকালই বলছি কেন? ইংরেজি সভ্যতাকৃষ্টির সংস্পর্শে এসে তারা সতীদাহ বন্ধ করল, বিধবা-বিবাহ আইন পাস করাল, তার পর সিভিল মেরিজ যার ভিতর তালাকের ব্যবস্থা রয়েছে, হালে হিন্দুশাস্ত্রমতো বিবাহ-প্রতিষ্ঠানের ভিতরও তালাকের ব্যবস্থা প্রবর্তিত করা হয়েছে।